A large quantity of gambling equipment seized in Chanditala: চুপচাপ বেগমপুরের গলিপথে রোজকার মতই চলছিল ব্যস্ততা, কেউ কিছু টেরও পায়নি, অথচ ভেতরে ভেতরে সেখানে রীতিমতো তৈরি হচ্ছিল বিপদের কারখানা। শব্দবাজির গন্ধে মিশে ছিল অনিরাপত্তা, আর সেই অদৃশ্য বিপদকে মুখোশ খুলিয়ে দিল চন্ডীতলা থানার পুলিশ। গোপন সূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সোমবার সন্ধ্যাবেলায় হানা দিয়ে প্রায় ৪৫০ কেজি বেআইনি বাজি এবং বিপুল পরিমাণ বাজি তৈরির মশলা ও যন্ত্রপাতি উদ্ধার করল পুলিশ। ঘটনাস্থল থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে দুই ব্যক্তিকে। জানা গেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে বিপজ্জনক ও বেআইনি কার্যকলাপ সংক্রান্ত ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে এবং মঙ্গলবার ধৃতদের শ্রীরামপুর আদালতে পেশ করা হবে। এই ঘটনায় রীতিমতো চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে চন্ডীতলা, বেগমপুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায়।পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, বাজি গুদামটি ছিল একটি পুরনো বাড়ির ভিতরে গোপনে গড়ে ওঠা কারখানায়। বাইরে থেকে কিছু বোঝার উপায় ছিল না। চন্ডীতলা থানার অফিসার ইনচার্জ জানান, “আমরা গোপন সূত্রে খবর পেয়ে অভিযান চালাই। বিপুল পরিমাণ বেআইনি বাজি ও তার উপাদান উদ্ধার হয়েছে। এই বাজি তৈরির কোনও সরকারি অনুমতি ছিল না। ধৃতদের জিজ্ঞাসাবাদ করে আমরা চেষ্টা করছি পুরো চক্রটি ভাঙার।”স্থানীয়দের অনেকেই বিষয়টি নিয়ে ভয় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। পাড়ার এক বাসিন্দা বলেন, “আমরা তো কিছুই জানতাম না, পাশে এত ভয়ংকর জিনিস তৈরি হচ্ছে! একটা বিস্ফোরণ হলেই পুরো পাড়া শেষ হয়ে যেত। ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভয়ে ভয়ে আছি।” অন্য একজন জানান, “শব্দবাজির জ্বালায় তো কানে তালা লেগে যায়, আর সেটা যদি বেআইনি ভাবে তৈরি হয় তাহলে তো আরও বিপদ। এসব এখনই বন্ধ করা দরকার।”
চন্ডীতলার বিভিন্ন অঞ্চলে বাজি তৈরির আড়ালে বেআইনি শব্দবাজির উৎপাদন বহুদিন ধরেই চলছে বলে স্থানীয় প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে। বেশ কয়েকটি ঘটনায় পূর্বেও অভিযান চালিয়ে বাজি ও তৈরির সামগ্রী উদ্ধার হয়েছে। তবে এতো বড়ো পরিমাণ বাজি ধরা পড়া এই প্রথম। পুলিশ সূত্রে আরও জানা যাচ্ছে, বাজিগুলি বেশিরভাগই শব্দবাজি, যার ওপর আগে থেকেই রাজ্য সরকারের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পরিবেশ রক্ষা ও শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সুপ্রিম কোর্টও শব্দবাজি ব্যবহারের ওপর বিধিনিষেধ দিয়েছে। তবুও বিক্রি ও উৎপাদন বন্ধ হয়নি।এই ঘটনার পরেই প্রশাসন আরও কড়া নজরদারি শুরু করেছে। চন্ডীতলার এক পুলিশ কর্তা বলেন, “আমরা এবার নিয়মিত রেইড করব। বিশেষ করে দুর্গাপুজো, কালীপুজোর আগে এই ধরনের বেআইনি বাজির রমরমা বেড়ে যায়। তাই আমরা আগে থেকেই ব্যবস্থা নিচ্ছি।” রাজ্যের দমকল বিভাগও এ ধরনের বাজি কারখানার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুত বলেই সূত্রের খবর।অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই ধরনের বেআইনি বাজি কারখানা শুধু স্থানীয় মানুষের জন্যই নয়, গোটা এলাকার জন্যই বড় বিপদ। কারণ এই বাজিগুলির কোনও গুণমান নিয়ন্ত্রণ নেই, নেই আগুন বা বিস্ফোরণের সুরক্ষা ব্যবস্থা। কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে নিয়ন্ত্রণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এই ধরনের কারখানা রীতিমতো ভয়ানক।স্থানীয় সমাজকর্মী পার্থ বিশ্বাস এই ঘটনার তীব্র নিন্দা করে বলেন, “সরকারকে আরও সক্রিয় হতে হবে। শুধু পুলিশ অভিযান চালালেই হবে না, সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে। কারখানা যদি পাশেই থাকে, কেউ না কেউ তো দেখেছে। তাহলে কেন প্রশাসনকে আগে জানানো হয়নি?”
চন্ডীতলার প্রাক্তন পঞ্চায়েত সদস্য তথা তৃণমূল নেতা হরিদ্বার মণ্ডল এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, “বেআইনি বাজি তৈরির বিরুদ্ধে প্রশাসনকে আরও শক্ত হাতে নামতে হবে। কালীপুজোর আগে এই সব বেআইনি কারবার বেশি বাড়ে, কারণ তখন চাহিদা থাকে অনেক বেশি। স্থানীয় নেতৃত্ব ও সাধারণ মানুষকে নিয়ে সচেতনতা শিবির করতে হবে।”অন্যদিকে স্থানীয় বিজেপি নেতৃত্ব অভিযোগ করেছেন, এই ধরনের কারখানাগুলির পিছনে শাসকদলের মদত থাকে বলেই বারবার তা বন্ধ হয় না। বিজেপি নেতা অরূপ ঘোষ বলেন, “বছরের পর বছর ধরে চন্ডীতলার বিভিন্ন জায়গায় বাজি তৈরি হয়, অথচ পুলিশ জানে না, এটা কি সম্ভব? আসলে ভোটের স্বার্থে এসব চক্রকে আশ্রয় দেওয়া হয়।”অভিযানে উদ্ধার হওয়া বাজি ও মশলার পরীক্ষার জন্য ফরেনসিক বিভাগে পাঠানো হচ্ছে বলে পুলিশ জানিয়েছে। যাতে স্পষ্ট বোঝা যায় কী ধরনের রাসায়নিক ব্যবহৃত হয়েছে এবং তার পরিমাণ কতটা ক্ষতিকর। একইসঙ্গে ধৃতদের মোবাইল ফোন ও যোগাযোগের মাধ্যমে চক্রের অন্য সদস্যদের ধরারও চেষ্টা চলছে।ঘটনার জেরে বেগমপুর সহ চন্ডীতলার বেশ কিছু জায়গায় পুলিশি টহল বাড়ানো হয়েছে। বাজির ব্যবসা ও উৎপাদনের সঙ্গে যুক্তদের ধরতে একটি স্পেশাল টাস্ক ফোর্স গঠনের কথাও ভাবছে হুগলি জেলা পুলিশ।এই ঘটনার পর অনেকেই বলছেন, কালীপুজো আসতে এখনও কিছুদিন বাকি, এখনই যদি এত বাজি তৈরি হয়, তাহলে পুজোর সময় কী হবে? পুলিশ ও প্রশাসনের উচিত এখন থেকেই কড়া ব্যবস্থা নেওয়া এবং এই চক্রকে গোড়া থেকে ধ্বংস করা।এটাই এখন চন্ডীতলার কাছে এক বড় প্রশ্ন—আর কতদিন এই বেআইনি বাজির আগুনে পুড়বে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা?