Workers protest in Panagarh industrial taluka demanding work:পানাগড় শিল্পতালুক যেন মঙ্গলবার সকালে হঠাৎ করেই এক বিষন্ন গল্পের মঞ্চে পরিণত হয়েছিল, যেখানে মুখ্য চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন এক দল অসহায় কিন্তু সাহসী শ্রমিক। সকাল থেকে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভের পেছনে ছিল দুঃখ, অবিচার আর অনিশ্চয়তার পাহাড়—আর ঠিক সেই পাহাড় ঠেলে এগিয়ে এলেন প্লাস্টিকের পাইপ তৈরির একটি বেসরকারি কারখানার প্রায় ১৪০ জন শ্রমিক। তাঁদের চোখে ছিল রাগ, কণ্ঠে ছিল প্রতিবাদের ঝাঁঝ আর কাঁধে ছিল সংসার টানার যন্ত্রণার ভার। দীর্ঘদিনের কাজের অনিশ্চয়তা, বেতন কাঠামোর পরিবর্তন, মাসে ২৬ দিন কাজের নিশ্চয়তা ও ন্যায্য পারিশ্রমিক—এসব ন্যায্য দাবিতেই আজ তাঁরা রাস্তায়। সকাল হতেই তাঁরা গেট আটকে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভে বসেন এবং সেখান থেকেই শুরু হয় উত্তেজনার। কারখানা কর্তৃপক্ষের তরফে কোনও সদুত্তর না মেলায় শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই বলেন, “আমরা বছরের পর বছর এখানে কাজ করছি, কিন্তু হঠাৎ করেই আমাদের বসিয়ে দেওয়া হলো, আর কিছু না বলেই!”

বিক্ষোভরত শ্রমিকদের মধ্যে ছিলেন প্রমিল দেবী, যিনি গত ৯ বছর ধরে এই কারখানায় কাজ করছেন। তাঁর কণ্ঠে তীব্র কষ্ট—“দেখুন, আমাদের হাতে কাজ নেই মানে ঘরে চাল নেই, বাচ্চার স্কুল ফিস নেই, মা-বাবার ওষুধ কেনার টাকা নেই। কাজ চাই আমরা, ভিক্ষা নয়।” পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা অপর শ্রমিক রফিকুল ইসলাম বলেন, “গত তিন মাসে বেতন সময়মতো দিচ্ছে না, আর এখন বলছে লোক কমিয়ে দিচ্ছে। আমরা কি পাথর খেয়ে বাঁচবো?” এইসব কথাগুলো শুধুই শব্দ নয়, এ যেন শ্রমজীবী মানুষের রক্তমাংসের আর্তনাদ।
জানা গেছে, বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী শ্রমিকদের বেশিরভাগই স্থানীয়, যাঁরা পশ্চিম বর্ধমান জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে এই কারখানায় কাজ করে নিজেদের পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন। কিন্তু সম্প্রতি হঠাৎ করেই ৭ জন ছাড়া বাকিদের ‘বসে পড়তে’ বলা হয়। অথচ কোম্পানির কাজ চলছে পুরোদমে। এতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠছে—কেন এই ছাঁটাই? কীসের ভিত্তিতে? শ্রমিকরা বলছেন, “আমরা কোনও নোটিস পাইনি, কোনও লিখিত কিছু নয়। শুধু বলে দিল – আজ থেকে তুমি আসতে পারবে না। এটা তো অন্যায়!” শুধু কাজ নয়, শ্রমিকদের দাবির মধ্যে ছিল বেতন কাঠামো সংশোধন, ওভারটাইমের হিসাব, পিএফ ও ইএসআই-এর স্বচ্ছতা, এবং মাসে কমপক্ষে ২৬ দিনের কাজের নিশ্চয়তা। তাঁদের মতে, এক মাসে যদি ঠিকঠাক কাজ না পান, তাহলে সংসার চালানো অসম্ভব।
এই ঘটনার খবর চাউর হতেই ঘটনাস্থলে পৌঁছায় কাঁকসা থানার পুলিশ। উত্তেজনা না বাড়িয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে তারা, কিন্তু শ্রমিকদের বক্তব্য, “পুলিশ এসে শুধু পরিস্থিতি শান্ত রাখার চেষ্টা করেছে, আমাদের সমস্যার কোনো সমাধান করেনি।” পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, তাঁরা কারখানা কর্তৃপক্ষ এবং শ্রমিকদের মধ্যে আলোচনার পথ খোলার চেষ্টা করছেন যাতে সমস্যা শান্তিপূর্ণভাবে মেটানো যায়। তবে, শ্রমিকদের হুঁশিয়ারি, দাবি না মানা পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
এই ঘটনাটি শুধু একটি কারখানার শ্রমিক সমস্যার প্রতিফলন নয়, বরং গোটা রাজ্যের শিল্পশ্রমিকদের দুর্দশার একটি প্রতীক হয়ে উঠেছে। কারণ, পানাগড় শিল্পতালুক রাজ্যের অন্যতম শিল্পকেন্দ্র হলেও, এখানে শ্রমিকদের নিরাপত্তা, ন্যায্য মজুরি ও চাকরি স্থায়িত্ব এখনও প্রশ্নচিহ্নের মুখে। অনেকেই বলছেন, “বড় বড় কোম্পানি আসে, লাভ করে যায়, কিন্তু শ্রমিকরা পড়ে থাকে সেই অভাব-অনটনের চক্রে।” এই ধরনের বিক্ষোভ যদি বারবার হয়, তাহলে রাজ্যে শিল্প পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, বিনিয়োগকারীরা পিছিয়ে যেতে পারেন, যার ফল ভুগবে আবার সাধারণ মানুষই।

কারখানা কর্তৃপক্ষের বক্তব্য এখনও পাওয়া যায়নি, কিন্তু সূত্রের দাবি—তারা আর্থিক চাপে রয়েছে এবং কাজের পরিমাণ কমে যাওয়ায় ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে। তবে শ্রমিকদের প্রশ্ন, “কাজ কমেছে, তাহলে দিনে ৭ জন দিয়ে কিভাবে কাজ হচ্ছে?” এ প্রশ্নের জবাব এখনও অজানা। রাজ্যের শ্রম দপ্তরের তরফ থেকেও এখনও কোনও প্রতিক্রিয়া মেলেনি। তবে এক স্থানীয় সমাজকর্মী সুদীপ মজুমদার বলেন, “এই ঘটনা শুধু পানাগড় নয়, গোটা পশ্চিম বর্ধমানের জন্য একটা সতর্কবার্তা। এখনই শ্রমিকদের ন্যায্যতা রক্ষা না করলে আগামী দিনে আরও বড় আন্দোলনের মুখোমুখি হতে হতে পারে প্রশাসন।”
পরিস্থিতির ভয়াবহতা এখানেই শেষ নয়। অনেক শ্রমিক পরিবার ইতিমধ্যে ঋণে ডুবে গেছেন। কেউ কেউ বলছেন, “গোটা মার্চ মাসে ১৮ দিন কাজ পেয়েছি, অথচ বেতন কেটে কেটে অর্ধেক দেওয়া হয়েছে। বাড়ি ভাড়া দিতে পারছি না, দোকানদার বাকিতে দিচ্ছে না, আমরা কী করবো?” এইসব প্রশ্নের উত্তর এখন সময়ের দাবি। শ্রমিক আন্দোলন শান্তিপূর্ণ থাকলেও, এর পেছনের অসন্তোষ জমছে ভিতরে ভিতরে। যদি প্রশাসন, কারখানা কর্তৃপক্ষ এবং শ্রমিক প্রতিনিধিদের মধ্যে দ্রুত সমাধান না হয়, তবে পরিস্থিতি যে আরও খারাপের দিকে যাবে, তা বলাই বাহুল্য।
অন্যদিকে, স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যেও উদ্বেগের সুর। তাঁরা বলছেন, “বিক্ষোভের জন্য এলাকায় যান চলাচলও বিঘ্নিত হচ্ছে। একদিকে শ্রমিকদের পাশে আছি, কিন্তু পরিস্থিতি যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে না যায়।” সামগ্রিকভাবে বলা যায়, পানাগড়ের এই শ্রমিক বিক্ষোভ একটি বড় বার্তা দিয়ে গেল—শুধু উৎপাদন নয়, উৎপাদকদের কথাও শোনা জরুরি। না হলে উৎপাদন থেমে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।