With the responsibility of the house on his shoulders, a lot of dreams in his eyes – Vikram fights for his life on the train: চোখে রোদ পড়ছে, পেছন দিয়ে ছুটে যাচ্ছে একের পর এক স্টেশন, আর একহাতে ঝুড়িভাজা-বাদামের প্যাকেট নিয়ে ট্রেনের কামরায় হেঁটে যাচ্ছে বছর তেরোর বিক্রম সুতার। কেউ ভাবতেই পারবে না এই ছোট্ট ছেলেটির কাঁধেই আজ একটা গোটা সংসারের ভার। বাবা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর থেকে মায়ের সঙ্গে শুরু হয়েছে জীবনের এক অসম লড়াই, আর সেই লড়াইয়ে ট্রেনই হয়ে উঠেছে বিক্রমের শ্রেণিকক্ষ, কামরাই তার দোকান। স্কুলের পাঠশালার বদলে আজ রোজকার জীবনের পাঠশালাই তাকে শেখাচ্ছে বেঁচে থাকার নয়া ব্যাকরণ।বিক্রমের বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার চাঁদপাড়া এলাকায়। মা দিনমজুর, অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। বাবা পরিবারের প্রতি চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীন, কারণটা অবিশ্বাস্য — “মেয়ে সন্তান জন্ম হয়েছে”, তাই একদিন সব ছেড়ে গা ঢাকা দেন। তখন থেকেই মা ও দুই ছেলেমেয়ের সংসারে শুরু হয় লড়াই, আর সেই লড়াইয়ে ছেলেটা পড়াশোনার খাতা ছেড়ে হাতে তুলে নেয় রুটি রোজগারের হাট।লোকাল ট্রেনের হকারি বিক্রমের বয়সের কাজ নয়, কিন্তু জীবনের তাগিদে ট্রেনের কামরায়, বিশেষত লেডিস কামরায়, সে আজও ঘুরে বেড়ায় বাদাম, ঝুড়িভাজা, পাটিসাপটা কিংবা কাগজের টিস্যু নিয়ে। এক কামরা থেকে আরেক কামরা, এক ট্রেন থেকে অন্য ট্রেন — বনগাঁ, গোবরডাঙা, হাবরা, বারাসত, শিয়ালদহ – বিক্রমের সকালটা শুরু হয় এক স্টেশন থেকে, শেষ হয় রাতের অন্ধকারে ঘরে ফিরে। সে বলেছে, “স্কুলে গেলে কোনও টাকা মেলে না, কিন্তু ট্রেনে ঘুরে বিক্রি করলে সংসার চলে।”
একজন সাধারণ ট্রেন যাত্রীর চোখে হয়তো সে হকার, কিন্তু একটু কথা বললেই বোঝা যায় — এই ছেলেটার মধ্যে লুকিয়ে আছে স্বপ্ন, দায়িত্ব আর একরাশ সাহস। তার কথায়, “আমার বোন ছোট, মা বাড়িতে কাজ করেন। আমি না করলে সংসার চলবে না।” বয়স তার মাত্র ১৩, কিন্তু গলার দৃঢ়তা যেন অনেক বেশি পরিণত।কিছুদিন আগেই তার ট্রেন বিক্রির একটি ভিডিও ভাইরাল হয় ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামে। কেউ একজন তাকে চুপচাপ ভিডিও করছিলেন, আর সেই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে — বিক্রম লেডিস কামরায় ঢুকে নম্রভাবে সবার উদ্দেশ্যে বলছে, “ঝুড়িভাজা আছে, পাটিসাপটা আছে, কিছু নেবেন?” এই ভিডিও দেখেই বিক্রমের জীবনগাথা ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলায়। নেটিজেনদের কেউ কেউ সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন, কেউ লিখেছেন – “ওই ছেলেটার চোখে আগুন, ওই ছেলেটাই ভবিষ্যতের আশা।”ট্রেনের হকারি খুব সহজ নয় — পুলিশি তল্লাশি, প্রতিযোগিতা, যাত্রীদের বিরক্তি – এসব তো রয়েইছে। তবু বিক্রম জানায়, “সব কামরায় লোকজন কেনে না, কিছু মানুষ শুধু কথা বলেন, ফটো তোলেন, কিছু কেনেন না। কিন্তু লেডিস কামরার দিদি-মাসিরা কিছু না কিছু কিনে নেন। ওঁরা খুব ভালো।”এখন, বিক্রম শুধু আর একা নয়। তার মতো অন্যান্য হকাররাও তাকে সহায়তা করে, কেউ পণ্য সরবরাহে সাহায্য করে, কেউ স্টেশনে জল এনে দেয়। তার প্রিয় হোটেল আছে — ‘কালিদি’র হোটেল’, যেখানে বিনামূল্যে একবাটি ভাত জুটে যায় দুপুরে। এইসব ছোট ছোট সাহায্যই তাকে বাঁচিয়ে রাখে।সাহায্যের পাশাপাশি তার মনেও আছে একটাই স্বপ্ন – “একদিন বড় হয়ে বোনকে পড়াশোনা শেখাবো। নিজেও আবার স্কুলে যাবো।” স্কুলছুট ছেলেটার মুখে যখন এই কথাগুলো উঠে আসে, তখনই বোঝা যায় — জীবনের পাঠ্যবই থেকে যে শিক্ষা সে নিচ্ছে, সেটা হয়তো কোনও স্কুলেও শেখানো যায় না।

খবর বাংলার পক্ষ থেকে আমরা কুর্নিশ জানাই বিক্রম সুতারকে। তার সাহস, তার লড়াই, তার পরিবারের প্রতি ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ — আজকের সমাজে বিরল। প্রশাসনের পক্ষ থেকে যদি বিক্রমের মতো এই শিশুদের জন্য বিশেষ শিক্ষাব্যবস্থা, হকার লাইসেন্স, সরকারি সাহায্যের কোনও প্রকল্প থাকে, তাহলে অনেকের জীবনই বদলে যেতে পারে।আমরা আশা করি, বিক্রমের গল্প শুধু ভাইরাল হোক না, বরং তার জীবনেও আলো আসুক। কেউ একজন যদি তার পড়াশোনার দায়িত্ব নেন, কেউ একজন যদি ট্রেনের বদলে তাকে স্কুলে ফিরিয়ে আনেন – তবে সেটাই হবে আসল সার্থকতা।এইরকম প্রতিটি বিক্রমের পাশে দাঁড়ানো উচিত সমাজের, প্রশাসনের, আমাদের সবার। কারণ, জীবনের ট্রেনে বিক্রমের মতো খুদেদের চোখে এখনো স্বপ্ন থাকে — শুধু দরকার একটু সহানুভূতির টিকিট।