Will India succeed in fulfilling its dream of becoming the world’s factory? : বিশ্ববাজারে একদিকে যেমন আমেরিকা ও চীনের মধ্যকার পুরনো শত্রুতা ধীরে ধীরে কিছুটা নরম হচ্ছে, তেমনই অন্যদিকে ভারত সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বে নতুন করে ‘ম্যানুফ্যাকচারিং হাব’ হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার এক সাহসী স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, এই স্বপ্ন আদৌ সফল হবে তো? যে সময়ে ওয়াশিংটন ও বেইজিং নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনর্গঠনের পথে হাঁটছে, সেই সময়ে ভারতের দিকে যেসব বহুজাতিক সংস্থা মুখ ফিরিয়ে তাকাচ্ছিল, তাদের অনেকের দোলাচলে পড়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এটা ভারতের জন্য কোনো অশনিসংকেত নয়, বরং এক নতুন কৌশলগত পথচলার শুরু হতে পারে। গল্পটা শুরু হয়েছিল ২০১৮-১৯ সালের দিকে, যখন ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে আমেরিকা ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধ তীব্র হয়ে উঠেছিল। তখনই বিশ্বব্যাপী উৎপাদন কোম্পানিগুলো চিন্তা করতে শুরু করে, শুধু চীনের ওপর নির্ভর করলে ভবিষ্যতে বড় বিপদ হতে পারে। সেই থেকেই উঠে আসে ‘চীন প্লাস ওয়ান’ (China Plus One) কৌশল। এই নীতির মাধ্যমে বহুজাতিক সংস্থাগুলো চীনের পাশাপাশি অন্য দেশেও উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা শুরু করে। ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়া—এই দেশগুলো সেই তালিকায় উঠে আসে। এই প্রেক্ষাপটেই ভারত একটি বড় সুযোগ দেখতে পায়। ভারত সরকারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ (Make in India) ও ‘প্রোডাকশন লিঙ্কড ইনসেনটিভ’ (PLI) স্কিম এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে। এসব প্রকল্পের মাধ্যমে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে নানা ছাড়, জমির সুবিধা, কর ছাড় ও লজিস্টিক ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো হয়। আর সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই অ্যাপল, সামসাং, ফক্সকন-এর মতো কোম্পানিগুলো ভারতীয় মাটিতে ধীরে ধীরে পা রাখতে শুরু করে। যেমন, অ্যাপল ইতিমধ্যেই আইফোন ১৫ মডেলের উৎপাদন চেন্নাইয়ের ফ্যাক্টরিতে শুরু করেছে, যেখানে লক্ষ লক্ষ ভারতীয় শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ফক্সকন তো সম্প্রতি ঘোষণা করেছে, তারা ভারতের কেরালা ও গুজরাটে নতুন প্লান্ট গড়ে তুলবে।

তবে এখানেই একটা আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। কারণ, সাম্প্রতিক কালে আমেরিকা ও চীনের মধ্যে কিছুটা বরফ গলতে শুরু করেছে। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি, দুই দেশের নেতৃত্ব নতুন করে এক বাণিজ্যিক সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের কথা বলেছে। এতে অনেকে মনে করছেন, যে কোম্পানিগুলো চীন থেকে সরিয়ে ভারতে উৎপাদন আনতে চাইছিল, তারা হয়তো আবার চিন্তাভাবনা শুরু করবে। কিন্তু বাস্তব চিত্রটা একেবারে উল্টো। বিশ্লেষক পরিমল চ্যাটার্জি বলছেন, “চীন আর আগের মতো সহজ গন্তব্য নয়। ওখানে শ্রম ব্যয় বাড়ছে, নিয়ম-কানুন কঠিন হচ্ছে, মার্কিন নিয়ন্ত্রণও আগের চেয়ে বেশি। তাই দীর্ঘমেয়াদে কোম্পানিগুলো বিকল্প খুঁজতেই থাকবে।” এই পরিস্থিতিতেই ভারতের কৌশলগত অবস্থান বড় শক্তি হয়ে উঠছে। দক্ষিণ এশিয়ার কেন্দ্রে থাকা ভারতের বৃহৎ বাজার, সস্তা শ্রমিক, দ্রুত উন্নত লজিস্টিক পরিকাঠামো ও সরকারের সহায়তামূলক নীতি—এইসব মিলিয়ে ভারত একটি আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠছে।
তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। ভারতের শ্রম আইন এখনো যথেষ্ট জটিল, জমির সমস্যা, আমলাতান্ত্রিক বিলম্ব, এবং বিদ্যুৎ বা পানীয় জলের মতো প্রাথমিক পরিকাঠামোর ঘাটতিও অনেক এলাকায় বিদ্যমান। আবার প্রযুক্তি হাব বা হাই-টেক উৎপাদনের জন্য দরকার যে প্রশিক্ষিত জনবল, তারও অভাব রয়েছে। যদিও সরকার নানা স্কিল ডেভেলপমেন্ট স্কিম চালু করেছে, কিন্তু বাস্তবে তার ফল পেতে কিছুটা সময় লাগবে।
এর মধ্যেই আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে আসছে—ভূরাজনৈতিক কৌশল। আমেরিকা এখন এমনিতেই চাইছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারসাম্য রক্ষা করতে ভারতকে পাশে রাখতে। তাই কৌশলগত কারণে হলেও যুক্তরাষ্ট্রের একাংশ চায় ভারত শক্তিশালী হোক, শিল্পে এগিয়ে যাক। অন্যদিকে, ভারতও কোয়াড বা অন্যান্য জোটের মাধ্যমে নিজেকে একটা কৌশলগত শক্তি হিসেবে তুলে ধরছে। এই পারস্পরিক স্বার্থের ফলেই, একটা সম্ভাব্য ‘ইন্দো-আমেরিকান ট্রেড ডিল’ আগামী কয়েক মাসে ঘোষণা হতে পারে। এই চুক্তির ফলে ভারতের পক্ষে বিদেশি বিনিয়োগ টানার পথ আরও প্রশস্ত হবে।
এই ছবিটা আরও স্পষ্ট হচ্ছে যখন দেখি শুধু উৎপাদন নয়, ভারত এখন রপ্তানি ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা নিচ্ছে। টেক্সটাইল, মোবাইল, ফার্মা, অটোমোবাইল—এই সব ক্ষেত্রে ভারতের রপ্তানি বেড়েই চলেছে। ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে ভারতীয় রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫০০ বিলিয়ন ডলার, যা এক দশক আগেও কল্পনার বাইরে ছিল।
আমরা যদি স্থানীয় প্রভাবের দিকে তাকাই, তাহলে এই ‘ভারতকে বিশ্ব কারখানা বানানোর’ প্রচেষ্টার ফলে রাজ্যভিত্তিক শিল্পতালিকায় পরিবর্তন আসছে। পশ্চিমবঙ্গ, মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, গুজরাট—এই রাজ্যগুলোতে শিল্পনগরী গড়ে উঠছে। তরুণ প্রজন্মের জন্য নতুন চাকরির দরজা খুলছে। নারী কর্মীরাও এখন উৎপাদন শিল্পে যুক্ত হচ্ছেন ব্যাপকভাবে। যেমন চেন্নাই ও বেঙ্গালুরুতে মহিলাদের জন্য আলাদা প্রোডাকশন ইউনিট তৈরি হয়েছে।
তবে দীর্ঘমেয়াদে ভারত যদি সত্যিই ‘বিশ্বের কারখানা’ হতে চায়, তাহলে তাকে শুধুই ‘সস্তা শ্রমিকের গন্তব্য’ নয়, বরং ‘উচ্চমানের প্রযুক্তি ও গুণগত মানের নির্ভরযোগ্য কেন্দ্র’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সরকার, বেসরকারি সংস্থা ও সাধারণ মানুষের মিলিত প্রচেষ্টায় তবেই গড়ে উঠবে এক নতুন ভারত, যেটি শুধু নিজের নয়, বিশ্বেরও চাহিদা মেটাতে পারবে।