Why is it important to eat vegetarian during the nine days of Navratri? What does Ayurveda and Hindu scriptures say?: নবরাত্রি — নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে আধ্যাত্মিকতার গভীরতা। ‘নব’ মানে নয় আর ‘রাত্রি’ মানে রাত। প্রতি বছর শরৎকালীন এই নয় রাত আর দশ দিন জুড়ে গোটা দেশজুড়ে মহামায়া দুর্গার আরাধনা চলে এক মহোৎসবের মতো। শহরের আলো ঝলমলে পূজামণ্ডপ থেকে শুরু করে গ্রামের মাটির ঠাকুরঘর— সর্বত্র একই সুর, শক্তির উপাসনা। কিন্তু নবরাত্রি মানেই শুধু পুজো, আলোকসজ্জা বা ঢাকের বাদ্য নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক বিশেষ খাদ্যাভ্যাস, যা মানুষকে মানসিক ও শারীরিকভাবে পবিত্র করে তোলে। প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত ধারণা, এই সময়ে নিরামিষ ও সাত্ত্বিক খাবার খেলে শরীর যেমন হালকা থাকে, তেমনই মন হয় প্রশান্ত। প্রশ্ন জাগে— কেন এই নয়দিন নিরামিষ খাওয়ার প্রথা? কেন মাংস, মাছ, ডিম, পেঁয়াজ, রসুন এড়িয়ে চলা হয়? এর উত্তর লুকিয়ে আছে আয়ুর্বেদ ও হিন্দু শাস্ত্রে।
আয়ুর্বেদের মূল ধারণা খাদ্যকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছে— সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক। সাত্ত্বিক খাবার যেমন দুধ, ফল, সবজি, ঘি, বাদাম— এগুলো শরীর ও মনের পবিত্রতা বাড়ায়, আত্মিক শক্তি জাগ্রত করে। রাজসিক খাবার যেমন ঝাল-মশলাদার পদ, অতিরিক্ত তেল-ঘি, এগুলো শরীরে উদ্দীপনা আনে বটে, কিন্তু মনকে অশান্ত করে। আর তামসিক খাবার— পেঁয়াজ, রসুন, মাংস, ডিম, মদ্যপান ইত্যাদি, শরীরকে ভারী করে তোলে, মনের উপর সৃষ্টি করে অলসতা, বিরক্তি আর নেতিবাচক ভাবনা। হিন্দু শাস্ত্র মতে, নবরাত্রির নয়দিন মা দুর্গার নানা রূপের পূজা হয়। এই সময়ে মানুষ নিজেকে প্রস্তুত করে তপস্যা ও আত্মসংযমের মাধ্যমে দেবী শক্তিকে আহ্বান করার জন্য। নিরামিষ খাবারই এই সংযমের প্রথম ধাপ। উপবাস বা ফলাহার কেবলই শারীরিক অনুশাসন নয়, এটি এক ধরনের আধ্যাত্মিক সাধনা।
বাঙালি সমাজে দেখা যায়, এই সময়ে অনেকেই শুধু ফল, দুধ, সাবুদানা বা সামক চালের খিচুড়ি খান। আবার উত্তর ভারতে মানুষ বেশি করে খান আলু, কাঁচা কলা, কুমড়ো, মাখন, মধু, বাদাম ও ডাবের জল। উপবাসের এই অভ্যাস শুধু ধর্মীয় কারণে নয়, বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতেও তা উপকারী। চিকিৎসকরা বলছেন, বছরে অন্তত একবার শরীরকে হালকা ও বিশুদ্ধ রাখা প্রয়োজন, যাতে হজমশক্তি বাড়ে এবং শরীরে জমে থাকা বিষাক্ত পদার্থ দূর হয়। নবরাত্রির খাদ্যাভ্যাস সেই সুযোগ করে দেয়।

কলকাতার আয়ুর্বেদ বিশেষজ্ঞ ডা. অরিন্দম ভট্টাচার্য বলেন, “উপবাস মানে শুধুই না খাওয়া নয়। বরং সহজপাচ্য ও পুষ্টিকর খাবার খেয়ে শরীরকে বিশ্রাম দেওয়াই আসল উদ্দেশ্য। এটি শরীরের ডিটক্সিফিকেশনের মতো কাজ করে।” শুধু চিকিৎসক নন, ধর্মীয় আচার্যরাও বলছেন নিরামিষ খাওয়ার মধ্যে আছে শাস্ত্রের গভীর ব্যাখ্যা। শ্রী শঙ্করাচার্য মঠের আচার্য স্বামী হরিদাস গিরি জানালেন, “নবরাত্রি মানে শক্তির জাগরণ। শক্তিকে ধারণ করতে গেলে চাই মন-প্রাণের পবিত্রতা। মাংস, মদ, পেঁয়াজ, রসুন এগুলো মনকে অস্থির করে। তাই শাস্ত্রে এই সময় সাত্ত্বিক খাদ্যের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।” এদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই অভ্যাস নিয়ে ভীষণ উৎসাহ। দক্ষিণ কলকাতার গৃহবধূ প্রতিমা দেবী বলেন, “আমি ছোটবেলা থেকেই মা দুর্গার আরাধনায় উপবাস করি।

প্রথম দুদিন ফলাহার করি, মাঝের দিনগুলোতে সামক চালের খিচুড়ি আর সব্জি খাই। এতে শরীর হালকা থাকে, মনও আনন্দ পায়।” অন্যদিকে তরুণ প্রজন্মও এখন ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করেছে এই অভ্যাসের বৈজ্ঞানিক দিক। কলেজ পড়ুয়া সৌমেন মণ্ডল জানায়, “আগে ভাবতাম উপবাস মানেই না খেয়ে থাকা। কিন্তু এখন জানি, এটি আসলে শরীরকে রিফ্রেশ করার মতো। নিরামিষ খাবার খেলে এনার্জি বাড়ে।” বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই অভ্যাস সমাজে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের পথও প্রশস্ত করছে। নবরাত্রির উপবাসের কারণে শহরের রেস্তরাঁগুলোতেও দেখা যাচ্ছে বিশেষ মেনু— সাবুদানা খিচুড়ি, সামক চালের পোলাও, দই-ফল মিশ্রণ, কচুরি নয়, বরং আলু-চপের নিরামিষ সংস্করণ। এমনকি অনেক দোকান মাংস বিক্রি বন্ধ রাখছে এই দিনগুলোতে।

বাজারে সব্জি, ফল ও দুধের চাহিদা বাড়ছে। অর্থাৎ এই খাদ্যাভ্যাসের প্রভাব পড়ছে সমাজ ও অর্থনীতির উপরেও। ভবিষ্যতের দিকে তাকালে মনে হয়, এই প্রথা শুধু ধর্মীয় আচার হিসেবেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং তা হবে স্বাস্থ্যসচেতনতার নতুন দিক। আজ যখন জাঙ্ক ফুডের ভিড়ে জীবন অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠছে, তখন নবরাত্রির মতো উৎসব আমাদের মনে করিয়ে দিচ্ছে— সরলতা, সংযম আর প্রকৃতির কাছাকাছি থাকাটাই আসল সুখের চাবিকাঠি। একদিকে দেবীর আরাধনা, অন্যদিকে শরীর-মনের বিশুদ্ধি— এই মিলনই নবরাত্রিকে করে তোলে সত্যিকারের ‘শক্তির উৎসব’।