Waterlogging at railway underpass creates danger : জলপাইগুড়ি জেলার পাহাড়পুর বড়ুয়াপাড়ার রেল আন্ডার পাসে জল জমে আজ যেন এলাকাবাসীর জীবনে নিত্যদিনের দুর্ভোগের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। বৃষ্টি হলে জল জমে হাঁটু সমান, আর সেই জলেই রোজ হাঁসফাঁস করতে হয় চারটি গ্রামের হাজারো মানুষকে। আন্ডার পাশ তো তৈরি হয় মানুষের যাতায়াতের সুবিধার্থে, অথচ এখানে সেটা রীতিমতো বিপদের রাস্তা। “এই রাস্তাটা দিয়ে আমাকেও প্রতিদিন যেতে হয়। কেমন ভয়ে থাকি, কখন যে পা পিছলে পড়ে যাই!” — বলছিলেন বছর পঞ্চাশের বাসিন্দা মাধব বর্মন, যিনি পঞ্চান্নঘাটা এলাকা থেকে প্রতিদিন এই আন্ডার পাশ দিয়েই কাজে যান। শুধু মাধববাবুই নন, এমন হাজারো পথচারী প্রতিদিন একই কষ্টের সম্মুখীন হচ্ছেন। অনেকেই তো বিকল্প রাস্তা না পেয়ে বাধ্য হয়ে রেলের মূল লাইনের উপর দিয়েই হাঁটছেন। যেটা যে কোনো মুহূর্তে বড়সড় দুর্ঘটনার ডেকে আনতে পারে। আন্ডার পাসে যখন হাঁটু সমান জল, তখন ট্রেনের লাইনের উপর দিয়ে যাওয়া ছাড়া পথ খোলা নেই। অথচ এই বিপদের চিত্র এলাকাবাসীদের কাছে যতটা পরিষ্কার, কর্তৃপক্ষের কাছে ততটাই আবছা, কিংবা তারা দেখেও না দেখার ভান করছেন বলেই অভিযোগ। স্থানীয় বাসিন্দা কৃষ্ণা দাস বললেন, “প্রতিদিন ছোট ছোট বাচ্চাদের স্কুলে যেতে হয় এই রাস্তা দিয়ে। অনেকে স্কুল ড্রেস পরে হাঁটু সমান জল ভেঙে যাচ্ছে। কতবার বলেছি আমরা! জনপ্রতিনিধি, রেল দপ্তর— কেউ শুনছে না।”
আসলে এই আন্ডার পাসের মূল সমস্যা শুধু জল জমা নয়, বরং তার নিচে থাকা অদৃশ্য গর্তগুলো। কয়েক বছর আগে রেলের তরফে এই আন্ডার পাশের জল বার করতে একটি JCB আনা হয়েছিল, কিন্তু তখন ওই মেশিনেই কয়েকটি গর্ত খুঁড়ে রাখা হয়, যেগুলোর কোনো নিষ্কাশন ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। ফলে আজ সামান্য বৃষ্টি হলেই সেই গর্তগুলিতে জমে থাকে এক হাঁটু জল। বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই কোন জায়গাটায় গর্ত, আর কোন জায়গায় মাটি। এর ফলে পথচারীরা প্রায় প্রতিদিন পড়ে যাচ্ছেন, কেউ হাত ভাঙছেন, কেউ কোমর ছিঁড়ে নিচ্ছেন। এক বৃদ্ধা, যিনি হাসপাতাল থেকে ফিরছিলেন, তিনি বলেন, “একদিন সন্ধ্যায় আমি এই রাস্তা দিয়ে ফিরছিলাম, গর্তটা দেখতে পাইনি, পড়ে গিয়ে পায়ে চোট লাগে, তিন সপ্তাহ বিছানায় শুয়ে ছিলাম।”
পাহাড়পুর বড়ুয়াপাড়ার চারপাশে অন্তত চারটি গ্রাম— ছোটবড় জনবসতিপূর্ণ। বাজার, হাসপাতাল, স্কুল সবকিছুর সংযোগ এই আন্ডার পাশের মাধ্যমেই। কাজেই এই দুরবস্থা যেন প্রতিদিনের রুটিন। স্কুল পড়ুয়া থেকে শুরু করে বৃদ্ধ ব্যক্তি, গর্ভবতী মহিলা থেকে শুরু করে কর্মস্থলে যাওয়া শ্রমজীবী মানুষ— সবার একটাই ভরসা ছিল এই আন্ডার পাশ। অথচ, সেটা আজ পরিণত হয়েছে মৃত্যুফাঁদে। এ বিষয়ে এক স্থানীয় যুবক সঞ্জয় রায় বলেন, “রেল আমাদের বলেছিল উন্নয়নের জন্য আন্ডার পাশ হচ্ছে। এখন বোঝা যাচ্ছে, এ উন্নয়ন আমাদের পঙ্গু করে দিচ্ছে।”
আরো উদ্বেগের বিষয়, এই সমস্যার কথা জানেন না এমন কোনো জনপ্রতিনিধি নেই। স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য থেকে শুরু করে রেলের আধিকারিক পর্যন্ত সবাই এই সমস্যার কথা জেনেছেন বহু আগে থেকেই। অভিযোগ উঠছে, একাধিকবার রেল দপ্তরের কাছে লিখিত অভিযোগ জানানো হলেও এখনো পর্যন্ত কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি। সমস্যাটা বর্ষাকালে প্রকট হলেও সারা বছরই এর প্রভাব থাকে। গর্তে জল না থাকলেও, মাটি কাদা হয়ে থাকে। ফলে সাইকেল, বাইক নিয়েও এই রাস্তা পেরোনো অত্যন্ত বিপজ্জনক। এক স্কুলশিক্ষক বলেন, “কয়েকদিন আগে এক ছাত্র এই গর্তে পড়ে যায়, বই-খাতা সব ভিজে যায়, কাঁদতে কাঁদতে স্কুলে আসে। কতটা অসহায় লাগে তখন।”
এই সমস্যার ভবিষ্যত প্রভাব নিয়েও চিন্তিত এলাকাবাসী। যদি দ্রুত কোনো নিষ্কাশন ব্যবস্থা না হয়, তবে আগামী দিনে জনরোষ চরমে উঠবে। এক প্রবীণ ব্যক্তি বলেন, “মানুষ অনেকদিন ধরে সহ্য করছে, কিন্তু আর কতদিন? একদিন হঠাৎ কিছু হলে দায় কে নেবে? তখন তো কেউ বলবে না আমি দায়ী।” স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, কয়েকজন যুবক নিজের উদ্যোগে জল বার করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু সেটা অস্থায়ী সমাধান মাত্র। সত্যিই যদি রেল কর্তৃপক্ষ চায় সমস্যার স্থায়ী সমাধান, তবে প্রয়োজন উন্নত জল নিষ্কাশন ব্যবস্থা, স্থায়ী গর্ত বন্ধ, ও নিয়মিত পরিদর্শন।
এই প্রতিবেদন লেখার সময়েও এলাকাবাসীদের চোখে-মুখে ছিল ক্ষোভ, হতাশা আর আশাহীনতা। অথচ এই ছবি আমরা দেখতে পাচ্ছি একবিংশ শতকে, যেখানে ডিজিটাল ইন্ডিয়া, স্মার্ট সিটি, এক্সপ্রেসওয়ে— এসব শব্দ চারপাশে ভাসছে, সেখানে মানুষকে হাঁটু জল ভেঙে বাঁচার লড়াই করতে হচ্ছে। আর রেল, যাদের দায়িত্ব নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে তোলা, তারা যেন এই সমস্যা দেখেই না।
খবর বাংলা’র তরফ থেকে রেল দপ্তরের আধিকারিকদের কাছে বারবার ফোন করে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও, কেউ ফোন তোলেননি। তবে এই প্রতিবেদনের মাধ্যমে আমরা আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দ্রুত এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানে এগিয়ে আসবে, নইলে রেল আন্ডার পাশ হবে শুধু একটা দুর্ঘটনার অপেক্ষার নাম।