Friday, May 30, 2025
Google search engine
Homeঅন্যান্যসুন্দরবনে মেঘ স্রোতের জোড়া তাণ্ডব, কাঁপছে নদীপাড়

সুন্দরবনে মেঘ স্রোতের জোড়া তাণ্ডব, কাঁপছে নদীপাড়

Twin cloudbursts wreak havoc in Sundarbans, shaking riverbanks: সুন্দরবনের আকাশ সকাল থেকে যেন এক অদ্ভুত আতঙ্কে ঢাকা পড়েছে – চারপাশে ধূসর মেঘের চাদর, দমকা হাওয়ার শোঁ শোঁ শব্দ, আর নদীপাড়ের মানুষের চোখেমুখে একরাশ অজানা শঙ্কা। ভোরবেলা থেকেই নদী বেয়ে বইছে অস্বাভাবিক জোরালো স্রোত, আর তার সঙ্গে মিলেছে দমকা হাওয়ার গর্জন। বিশেষ করে সুন্দরবনের ঝড়খালি, গড়াল, হেনরিঅ্যাইল্যান্ড, লাহিড়ীপুর, সজনেখালি, বাসন্তী, গোসাবা, পাথরপ্রতিমা – এই নদীপাড়ের গ্রামগুলোতে আতঙ্ক যেন ক্রমেই বাড়ছে। নদীর বুক ফুলে উঠছে, ভাটার সময়েও নদী বয়ে চলেছে অস্বাভাবিক বেগে, আর নদীর বুক থেকে উঠে আসছে ৩-৪ ফুট উঁচু ঢেউ। নদীর এমন আচরণে এলাকার বাসিন্দারা ভয় পেয়ে গেছেন, অনেকে ইতিমধ্যেই বাড়িঘর থেকে দূরের স্থানে সরতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে যারা নদী পাড়ে থাকেন, তারা তাদের নৌকা-ডিঙ্গি বেঁধে রাখছেন, মাছ ধরার সমস্ত জাল গুটিয়ে রাখছেন, আর বড় নৌকাগুলোকে বেঁধে ফেলেছেন শক্ত দড়িতে, যাতে হাওয়া ও স্রোতের ঝাপটায় না ভেসে যায়। এক স্থানীয় মৎস্যজীবী রামপ্রসাদ মণ্ডল বললেন, “ভোর থেকে নদীর আচরণ ঠিক মনে হচ্ছে না। আমাদের বড়দের মুখে শুনেছি, এরকম ঢেউ আর স্রোত দেখা মানেই কিছু একটা হতে চলেছে। তাই আর নদীতে নামছি না।” ঠিক এই পরিস্থিতিতে আবহাওয়া দফতরের পূর্বাভাস নতুন করে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের বিজ্ঞানী সোমনাথ পাল জানিয়েছেন, “উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে একটি নিম্নচাপ তৈরি হয়েছে, যা ধীরে ধীরে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হচ্ছে। আগামী ১২ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সুন্দরবনের উপকূলবর্তী অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে, আর সেই সঙ্গে ঘণ্টায় ৫০-৬০ কিলোমিটার বেগে দমকা হাওয়া বইতে পারে।

” প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সুন্দরবনের প্রত্যন্ত ব্লকগুলিতে সতর্কতা জারি করা হয়েছে, নৌকা-মাছ ধরার ট্রলারে যাওয়ার উপরে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, আর জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুম ২৪ ঘণ্টা খোলা রয়েছে। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক মৌসুমি মুখার্জি জানিয়েছেন, “আমরা প্রতিটি ব্লক অফিসে নজরদারি বাড়িয়েছি। বিশেষ করে ঝড়খালি, সজনেখালি, বাসন্তী, গোসাবা – এই এলাকাগুলোতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। প্রতিটি নদীপাড়ের গ্রামে মাইকিং করা হচ্ছে, যাতে মানুষ সতর্ক থাকে।” সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদের এক কর্মকর্তা বলেন, “এখানে যে কোনও দুর্যোগ এলেই নদীপাড়ের মানুষ সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই আগেভাগেই নৌকা তোলা, জাল গোটানো আর খাদ্যসামগ্রী মজুতের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।” নদীর জলস্তর ক্রমশ বাড়তে থাকায় নদীবাঁধের উপর চাপ বাড়ছে। অনেক জায়গায় ছোট ফাটল দেখা যাচ্ছে, যদিও স্থানীয় পঞ্চায়েতের তরফ থেকে তৎক্ষণাৎ মাটি, বালি ভর্তি বস্তা ফেলে সেই ফাটল আটকানোর চেষ্টা চলছে। সুন্দরবনের মানুষ যে প্রকৃতির সঙ্গে প্রতিনিয়ত লড়াই করে বাঁচে, তা আবারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এই পরিস্থিতি। এক স্থানীয় স্কুলশিক্ষক মনোরঞ্জন সর্দার বললেন, “প্রতি বছরই এই সময়টায় আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়ে থাকি। কখনও ইয়াস, কখনও ফণী, কখনও আমফান – আর এবারও যদি ঝড় হয়, তাহলে আবার সব শেষ হয়ে যাবে।

sundarban1 1581931698

” সুন্দরবনের বাসিন্দাদের জন্য বরাবর সবচেয়ে বড় শঙ্কা নদীর বাঁধ ভেঙে জল ঢুকে পড়া। কারণ বাঁধ ভাঙলেই নিমেষের মধ্যে প্লাবিত হয়ে যায় গ্রামের পর গ্রাম। ২০২০ সালের আমফান ঝড়ের সময় সুন্দরবনের বহু এলাকায় বাঁধ ভেঙে নদীর জল ঢুকে পড়েছিল, আর সেই ক্ষতের স্মৃতি এখনো টাটকা। তাই এবারও মানুষ আগেভাগেই তৈরি থাকছেন – শুকনো খাবার, মোমবাতি, পলিথিন, ওষুধ, দড়ি, বাতাসের টিউব – সবকিছু মজুত করে রাখছেন। এদিকে, মৎস্যজীবীদের বড় অংশ নদীতে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, কারণ দমকা হাওয়ায় নৌকা উল্টে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। দীঘা আবহাওয়া কেন্দ্রের আধিকারিক অরিন্দম দত্ত জানিয়েছেন, “আগামী ২৪ ঘণ্টা সুন্দরবনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। বৃষ্টি, দমকা হাওয়া আর নদীর স্রোত – সব মিলিয়ে নদীপাড়ের মানুষদের সতর্ক থাকতে হবে।” সুন্দরবনের প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্রও এই ধরণের দুর্যোগে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুন্দরবনের বাঘ, কুমির, চিত্রল হরিণের মতো জীববৈচিত্র্যও নদীর জলস্তর বেড়ে গেলে বিপন্ন হয়ে পড়তে পারে। পরিবেশবিদ অরিত্রা সাহা জানিয়েছেন, “প্রতিটি ঘূর্ণিঝড় সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের জন্য এক ধরণের ধাক্কা। এবারও যদি পরিস্থিতি খারাপ হয়, তাহলে এর প্রভাব শুধু মানুষের জীবনে নয়, পরিবেশের উপরেও পড়বে।” সবমিলিয়ে সুন্দরবন এখন এক অজানা আশঙ্কায় প্রহর গুনছে – কখন কোথা থেকে তাণ্ডব নেমে আসবে, তারই আতঙ্কে দিন কাটছে নদীপাড়ের মানুষদের।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments