Trinamool on the road demanding road repair : শনিবার সকালটা ছাতনার জন্য আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতো ছিল না। সকাল ১০টা বাজতেই ছাতনা স্টেশন চত্বরে জড়ো হতে থাকেন তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থকরা। কেউ হাতে পোস্টার, কেউ মুখে স্লোগান—”রেল কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙাও”, “রাস্তা চাই, প্রতিশ্রুতি নয়”—এইসব আওয়াজে মুহুর্মুহু মুখর হয়ে ওঠে এলাকা। কারণ? স্টেশনে যাওয়ার যে রাস্তাটা দিনের পর দিন বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়ে রয়েছে, তারই সারাইয়ের দাবিতে এবার তৃণমূল পথে। এলাকার মানুষজনও পাশে এসে দাঁড়ান, কারণ এই সমস্যাটা শুধুমাত্র রাজনীতি নয়, বরং একেবারে জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক দৈনন্দিন ভোগান্তি। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, ছাতনা স্টেশনের দিকে যাওয়ার রাস্তা রেলের অন্তর্গত, আর সেই রাস্তা বহুদিন ধরেই খারাপ অবস্থায় পড়ে আছে। বিশেষ করে বর্ষাকালে কাদা, জলজমা, আর উঁচু-নিচু রাস্তার কারণে বিপদের আশঙ্কা থেকেই যায়। যাত্রীদের পড়তে হচ্ছে দুর্ঘটনার মুখে, আর অসুবিধার শিকার হচ্ছেন এলাকার সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে মহিলারা ও বৃদ্ধরা।তৃণমূলের ব্লক সভাপতি শঙ্কর হালদার বলেন, “দীর্ঘদিন ধরে রেল কর্তৃপক্ষকে জানানো হচ্ছে এই রাস্তার দুর্দশার কথা। আমাদের দলের প্রতিনিধি দল রেলের দপ্তরে লিখিত অভিযোগও জানিয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনও উদ্যোগ দেখা যায়নি। বরং সমস্যা দিন দিন আরও বেড়েছে।” এলাকাবাসী মিতালী দত্ত, যিনি প্রতিদিন কাজে যেতে এই পথ ব্যবহার করেন, জানান, “আমরা মহিলা যাত্রীরা এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে স্টেশনে যাই। শৌচালয় তো প্রায় সর্বক্ষণ বন্ধ থাকে। তার ওপর রাস্তা এত খারাপ যে পায়ে হেঁটে যেতেও ভয় হয়। একদিন না একদিন বড় দুর্ঘটনা হবেই।”
আসলে এই ছাতনা স্টেশনটা শুধু একটা ট্রেন ধরার জায়গা নয়—এটা এলাকার একমাত্র মূল সংযোগস্থল। এখান থেকে ব্যাঙ্কুরা, পুরুলিয়া, এমনকি কলকাতাগামী যাত্রীরা প্রতিদিন যাতায়াত করেন। প্রত্যেকদিন হাজার হাজার মানুষ এই পথ দিয়ে হেঁটে, সাইকেলে বা বাইকে যাতায়াত করেন। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষের কাছে যেন এই সমস্যাটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। এলাকাবাসীর বক্তব্য, “আমাদের ভোট লাগে, কিন্তু পরিষেবা দিতে কেউ রাজি নয়। রাস্তা নিয়ে এত আন্দোলনের পরেও যদি কোনও সুরাহা না হয়, তাহলে আমরা এবার বৃহত্তর আন্দোলনে নামব। প্রয়োজনে ট্রেন অবরোধ করব।”রেল সূত্রে এখনও পর্যন্ত কোনও প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তবে ছাতনা স্টেশনের সাব-ইনচার্জকে বিষয়টি জানানো হয়েছে বলে খবর। যদিও এলাকার মানুষ ও তৃণমূলের তরফে দাবি করা হচ্ছে, শুধু জানানো নয়, অবিলম্বে কাজ শুরু হোক। বিক্ষোভ মঞ্চ থেকেই তৃণমূল নেত্রী রেণু দেবী বলেন, “আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছি। রেল যদি এবারও না শোনে, তাহলে আমাদের হাতে বিকল্প কিছু থাকবে না। বৃহত্তর আন্দোলনের দিকে যাব আমরা। এটা কোনও রাজনৈতিক ইস্যু নয়, জনজীবনের সঙ্গে যুক্ত এক অপরিহার্য দাবি।”বিশেষ করে যেটা চোখে পড়ার মতো, তা হল মহিলা ও বয়স্কদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। পথ বিক্ষোভে অনেকেই হেঁটে আসেন একে অপরের হাত ধরে, কেউ লাঠিতে ভর দিয়ে, কেউ আবার ছোট শিশুদের কোলে নিয়ে—তাদের চোখেমুখে একটা দাবি: “আমাদেরও মানুষ মনে করুন।” এলাকার আরেক প্রবীণ বাসিন্দা মৃণাল কান্তি সাহা বলেন, “এই রাস্তা দিয়ে ৫০ বছর ধরে চলছি। আগে কখনও এত খারাপ অবস্থা হয়নি। এখন তো কাদা-জলে ভরে যায় পুরোটা। রিকশাও যেতে চায় না। শুনেছি এটা রেলের আওতায় পড়ে, কিন্তু রেলের এত উদাসীনতা কেন?”

ঘটনার পর তৃণমূল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে একটি স্মারকলিপিও রেল কর্তৃপক্ষকে পাঠানো হয়েছে। স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে রেল আধিকারিকদের একটি বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে আগামী সপ্তাহে। যদিও এই পরিস্থিতি ততক্ষণে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা কেউ জানে না।সাম্প্রতিক বছরগুলিতে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় এমন অব্যবস্থার ঘটনা সামনে এসেছে। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, মেদিনীপুর, এমনকি হাওড়া এবং শিয়ালদহ সংলগ্ন এলাকাতেও রাস্তাঘাটের করুণ অবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রেল কর্তৃপক্ষের ঢিলেমি মনোভাবই থেকে গেছে অপরিবর্তিত। এর একটা বড় কারণ কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে থাকা ভারতীয় রেলের প্রশাসনিক জটিলতা। রাজ্য সরকারের তরফ থেকে বারবার জানানো হলেও ব্যবস্থা নিতে সময় লাগে, আর এই দেরির খেসারত দেন সাধারণ যাত্রীরা।তৃণমূল কংগ্রেস যে এই ইস্যুতে এখন কোনওরকম আপস করতে নারাজ, তা শনিবারের বিক্ষোভে স্পষ্ট বোঝা গেছে। উপস্থিত জনতার সংখ্যাও দেখিয়ে দিয়েছে, এই সমস্যা নিয়ে মানুষের ক্ষোভ কতটা গভীর। একজন স্কুল শিক্ষক, যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, বলেন, “আমরা রাজনীতি করি না। কিন্তু একটা ভালো রাস্তার জন্য যদি রাজনীতির দরকার পড়ে, তাহলে সেটাও করব। কারণ এটা আমাদের প্রাপ্য।”এই প্রতিবাদ কর্মসূচি যে আগামী দিনে অন্য এলাকাগুলিকেও উৎসাহিত করতে পারে, সে আশঙ্কা বা আশাবাদ দুই-ই রেল কর্তৃপক্ষের মাথায় রাখা উচিত। তৃণমূল নেতৃত্ব হুঁশিয়ারি দিয়েছে, “এখন শুধু ছাতনা, কাল হতেই পারে বাঁকুড়া, মেদিনীপুর বা আরও কোথাও। যতক্ষণ না রেল কর্তৃপক্ষ সমস্যার বাস্তব সমাধান করে, আমাদের প্রতিবাদ চলবেই।”এই মুহূর্তে ছাতনা স্টেশনের সেই ভাঙাচোরা রাস্তার পাশে শোভা পাচ্ছে কিছু ব্যানার—“রাস্তা চাই, প্রতিশ্রুতি নয়”, “যাত্রীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করুন”, “মেয়েদের জন্য শৌচালয় খুলুন”—এই ব্যানারগুলো যেন রেলকে প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দিচ্ছে, আর দেরি নয়।