Touch of red clay at New Digha Festival: নিউ দীঘার হেলিপ্যাড ময়দান যেন এক টুকরো লাল মাটির দেশ হয়ে উঠেছে। পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূমের মতো জেলার মাটি, মানুষ, গান, শিল্প আর সংস্কৃতি এবার এসে মিশেছে দীঘার নোনা হাওয়ার সঙ্গে। কারণ ২০২৫ সালের নিউ দীঘা উৎসবের থিমই হল — “লাল মাটির দেশে”। একদিকে সমুদ্র, আর একদিকে লাল মাটির রঙে মাখামাখি প্যান্ডেল, ধামসা-মাদলের তালে রাত জাগা গ্রামবাংলা, যেন এক মোহময় সাংস্কৃতিক মিলনমেলা। দীঘার হেলিপ্যাড ময়দানে ২৮তম বর্ষে পদার্পণ করল এই উৎসব, যার মূল আয়োজক নিউ দীঘার সম্প্রীতি সংঘ। জাতিমাটি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন বিশাল মাঠে চলেছে এই উৎসব, আর সেই সঙ্গে জমে উঠেছে মানুষের ভিড়, উৎসাহ, আনন্দ আর আবেগ। এলাকার মানুষ তো বটেই, দূর-দূরান্ত থেকে আসা হাজার হাজার পর্যটকের মন কেড়েছে এই ভিন্ন স্বাদের আয়োজন।চোখে পড়ার মতো বিষয় হল, এবারের মণ্ডপ সজ্জায় ছিল একেবারে অভিনবত্বের ছোঁয়া। গেটে ঢুকতেই যেন মনে হচ্ছে কোনও বাউল মেলার মাঠে ঢুকেছি – চারপাশে খড়ের ঝাঁপি, টাঙানো ঝোলানো তালপাতার পটচিত্র, রঙিন ঝাণ্ডা আর গ্রামীণ শিল্পের মনকাড়া উপস্থাপন। সংগঠনের সভাপতি রণজিৎ দাস বলছেন, “প্রতি বছর আমরা নতুন কিছু ভাবার চেষ্টা করি। এবার ভাবলাম, দীঘার মত শহরে গ্রামবাংলার আদিবাসী ও লাল মাটির সংস্কৃতিকে তুলে ধরা হোক। এতে পর্যটকরাও ভিন্ন স্বাদে দীঘা উপভোগ করবেন, আর আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির প্রসারও হবে।”
এই উৎসবে রয়েছে সর্বজনীন পুজো – শ্রী শ্রী শীতলা মাতা, মনসা মাতা, সরস্বতী মাতা ও সত্যনারায়ণ দেবের পুজো সম্পূর্ণ জনসমাগমে ও ভক্তিভরে সম্পন্ন হচ্ছে। সেই সঙ্গে চলছে ৩২ প্রহর হরিনাম সংকীর্তন, ১৪ প্রহর মাদক, যাত্রাপালা, কীর্তন ও ভক্তিগীতি। প্রাচীন গ্রামীণ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে এই পূর্ণাঙ্গ আয়োজন, যেখানে ধর্মের সঙ্গে মিশে গেছে উৎসব, আর ভক্তির সঙ্গে লেগেছে আনন্দের রঙ।দেখা গেল, মেলার মধ্যে বসেছে বিশাল কৃষি ও গ্রামীণ শিল্প মেলা। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কৃষকরা এনেছেন তাঁদের উৎপন্ন বীজ, সার, জৈব পদ্ধতির ফসল এবং হস্তশিল্প সামগ্রী। প্রদর্শনীতে রয়েছে বাঁশের তৈরি ঝুড়ি, কুলার, সাঁওতালি গয়না, পটচিত্র, পোড়ামাটির জিনিসপত্র ও আরও অনেক কিছু। ট্যুরিস্টদের অনেকেই এগুলোর প্রতি গভীর আগ্রহ দেখাচ্ছেন। কলকাতা থেকে আসা পর্যটক মালবিকা চৌধুরী জানালেন, “দীঘা তো অনেকবার ঘোরা হয়েছে, কিন্তু এবারে যে প্যান্ডেল, যাত্রা আর কীর্তনের এই পরিবেশ তাতে মনে হচ্ছে যেন কোনও মফস্বলের দুর্গাপুজোয় এসেছি। এক কথায় দারুণ।”সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হচ্ছে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান – থাকছে বাউল গান, ছৌ নাচ, ঝুমুর, আদিবাসী নৃত্য, কবিগান থেকে শুরু করে যাত্রাপালা। মঞ্চে উঠছে বহু প্রখ্যাত শিল্পী। এবারে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলার জনপ্রিয় লোকসংগীত শিল্পী বেবি নাজনীন ও ছৌ গানের জনপ্রিয় মুখ ধ্রুব বক্সী। পাশাপাশি মঞ্চে অংশ নিয়েছে স্থানীয় শিশু-কিশোররাও। এত বড় উৎসবে তাদেরও জায়গা করে দেওয়াটা প্রশংসনীয় উদ্যোগ বলে জানিয়েছেন পর্যটকরা।

উৎসব উপলক্ষে নিরাপত্তার দিকেও বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। পুলিশ প্রশাসনের তরফ থেকে রয়েছে কড়া নজরদারি, পর্যাপ্ত সিসিটিভি ক্যামেরা, মেডিক্যাল টিম ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। দীঘা থানার আইসি পিনাকী ভৌমিক জানিয়েছেন, “দীঘা পর্যটন কেন্দ্র বলেই এখানে ভিড় বেশি হয়, আমরা প্রতি বছরই এই উৎসবে সহযোগিতা করি, তবে এবারের ভিড় অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে।”দীঘা পর্যটন দফতরের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, “এই ধরণের সাংস্কৃতিক উৎসব পর্যটন শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ করে। শুধু সমুদ্র না দেখে মানুষ যখন এখানে গ্রামবাংলার সংস্কৃতি দেখে, তখন দীঘার প্রতি একটা আলাদা টান তৈরি হয়।”দীঘার হোটেল-মোটেল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে, এই ধরণের উৎসবের ফলে শুধু পর্যটন নয়, রুজি-রোজগারও বাড়ে। হোটেল ভাড়া, গাড়ির চাহিদা, খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে স্থানীয় দোকানদারদের ব্যবসাও চাঙ্গা হয়। “আমরা চাই এই উৎসব প্রতি বছর হোক এবং আরও বড় পরিসরে হোক,” বললেন দীঘা হোটেল ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক মধুসূদন জানা।এই উৎসবের মাধ্যমে একটা বিষয় স্পষ্ট – পশ্চিমবঙ্গের সমুদ্রতট আর গ্রামবাংলা একসূত্রে বাঁধা যাচ্ছে, যেখানে সমুদ্রের ঢেউ আর ধামসা-মাদলের বোল মিলেমিশে এক অপূর্ব আবেগ তৈরি করছে। দীঘা শুধু রোমান্টিক সফরের গন্তব্য নয়, এটা হতে পারে বাংলার সংস্কৃতির গর্বও। লাল মাটির এই ছোঁয়া যেন আরও বহু বছর ধরে দীঘার বুকে ছড়িয়ে পড়ে, এই আশায় বুক বেঁধেছে স্থানীয় মানুষ থেকে শুরু করে পর্যটকরাও।