Thunderstorms forecast in various districts across the state : পশ্চিমবঙ্গের আকাশ যেন আবার ভেঙে পড়ার অপেক্ষায়। রাজ্যজুড়ে একটানা কয়েকদিন ধরে গরমে হাঁসফাঁস করা মানুষের জন্য একদিকে যেমন বৃষ্টির খবরে স্বস্তির হাওয়া, তেমনি অন্যদিকে নিম্নচাপের ফলে সম্ভাব্য ঝড় ও বজ্রবিদ্যুৎ-সহ ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাসে শুরু হয়ে গেছে চিন্তা ও প্রস্তুতির তোড়জোড়। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের সর্বশেষ বুলেটিনে জানানো হয়েছে, ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন দক্ষিণাঞ্চলে একটি সক্রিয় নিম্নচাপ অবস্থান করছে। মৌসুমী অক্ষরেখা ছাড়াও চারটি পৃথক অক্ষরেখা রাজ্যের উপর দিয়ে বিস্তৃত এবং তিনটি ঘূর্ণাবর্ত সারা দেশের আবহাওয়াকে প্রভাবিত করছে। এই সবকিছুর ফলেই শুক্রবার থেকে রাজ্যের প্রায় প্রতিটি জেলায় সম্ভাব্য বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টি ও ঝড়ের সতর্কতা জারি হয়েছে। বিশেষ করে পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, বীরভূম এবং মুর্শিদাবাদ জেলার মানুষদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের কলকাতা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও পূর্ব মেদিনীপুরেও প্রবল ঝড়বৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে। আবহাওয়াবিদ সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় ‘খবর বাংলা’কে জানিয়েছেন, “ঝাড়খণ্ড সংলগ্ন নিম্নচাপ খুব ধীরে উত্তর-পূর্ব দিকে সরে আসছে।
এর ফলে রাজ্যের অভ্যন্তরীণ এলাকায় ও উপকূল অঞ্চলে দুই ধরনের প্রভাব পড়ছে—একদিকে বৃষ্টির সম্ভাবনা যেমন বাড়ছে, তেমনি আর্দ্রতা বৃদ্ধির ফলে জনজীবন অস্বস্তিতে পড়ছে।” তিনি আরও বলেন, “আগামী ৪৮ ঘণ্টা রাজ্যের অধিকাংশ জেলায় বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে, কোথাও কোথাও ৫০ থেকে ৬০ কিমি প্রতি ঘণ্টা গতিবেগে ঝোড়ো হাওয়া বইতে পারে।” শহর কলকাতায় শুক্রবার সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২৬.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ ৮৯ থেকে ৯৮ শতাংশের মধ্যে, যা প্রচণ্ড ঘাম ও অস্বস্তি তৈরি করছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় শহরের তাপমাত্রা ২৬ থেকে ৩১ ডিগ্রির মধ্যে ঘোরাফেরা করবে। দক্ষিণবঙ্গের পাশাপাশি উত্তরবঙ্গেও প্রবল বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। বিশেষ করে মালদহ, উত্তর দিনাজপুর ও দক্ষিণ দিনাজপুরে ভারী বৃষ্টি হতে পারে বলে জানানো হয়েছে। জলপাইগুড়ি ও কোচবিহারেও মেঘ জমে রয়েছে। একটানা বৃষ্টির আশঙ্কায় নদী ও পাহাড়ি এলাকাগুলিতে ইতিমধ্যে প্রশাসনিক তৎপরতা শুরু হয়েছে। মুর্শিদাবাদের কান্দি এলাকার বাসিন্দা কৃষক সনাতন শেখ বলেন, “এই সময়টা আমাদের ধানের বীজ বোনার, কিন্তু যদি এমন বজ্র-সহ বৃষ্টি হয় তাহলে ক্ষেত ভেসে যাবে। আবার না হলেও সমস্যা। এই অনিশ্চয়তা আমাদের মাথায় হাত দিয়ে দিয়েছে।” বাঁকুড়ার ছাতনা ব্লকের গৃহবধূ চুমকি সিংহ বলেন, “শুনেছি বৃষ্টি হবে, তাই সকালের বাজারটা করে নিয়েছি। গতবার হঠাৎ বৃষ্টিতে ছেলেকে স্কুল থেকে ভিজে ফেরত আনতে হয়েছিল।” পুরুলিয়ার বাঘমুন্ডি এলাকার স্কুল শিক্ষক সোমনাথ মাহাতো বলেন, “আমাদের অঞ্চলে ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চলে যায়। এখন স্কুল চলছে, বাচ্চাদের ঝড়বৃষ্টির মধ্যে পাঠানো ঝুঁকির কাজ। আশা করছি প্রশাসন আগেভাগে কিছু ব্যবস্থা নেবে।” এদিকে, কলকাতা পুরসভা, দমকল ও বিপর্যয় মোকাবিলা দফতর প্রতিটি ওয়ার্ডে নজরদারি বাড়ানোর কথা জানিয়েছে।
কলকাতা পুরসভার চেয়ারম্যান বিবেক গুপ্ত ‘খবর বাংলা’কে বলেন, “আমরা ড্রেন পরিষ্কার করার কাজ বাড়িয়েছি, যাতে বৃষ্টির জল জমে না থাকে। প্রতিটি ওয়ার্ড অফিসে মজুত রাখা হয়েছে অতিরিক্ত পাম্প ও কর্মী। বিদ্যুৎ বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে ঝুঁকিপূর্ণ গাছ কাটারও কাজ চলছে।” দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়, বাসন্তী ও কাকদ্বীপে নদী তীরবর্তী এলাকায় মৎস্যজীবীদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে জেলা প্রশাসন। কাকদ্বীপের জেলেরা জানিয়েছেন, তারা সমুদ্রে যাত্রা বন্ধ করেছেন অন্তত ৩ দিনের জন্য। মাছ ধরার ট্রলারগুলি ইতিমধ্যে ঘাটে ফিরে এসেছে। কৃষকদের পক্ষ থেকেও দাবি উঠেছে, যাতে ঝড়-বৃষ্টির জন্য ফসলের ক্ষয়ক্ষতির জন্য আগেভাগে ব্লক অফিসে নাম নথিভুক্ত করতে দেয়। আলিপুর আবহাওয়া দফতর থেকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে—এই সময়ে বজ্রপাত থেকে বাঁচতে খোলা মাঠ, উঁচু গাছের নিচে বা জলাশয়ের ধারে দাঁড়ানো থেকে বিরত থাকুন। খড়গপুর IIT-এর আবহাওয়া গবেষক দীপক ঘোষ বলছেন, “এই নিম্নচাপের প্রভাবে আগস্ট মাসে বর্ষার চরিত্র কিছুটা সক্রিয় হয়ে উঠবে বলে অনুমান। তাই আগামী দিনে আবারও এমন পরিস্থিতি দেখা যেতে পারে।” শহরাঞ্চলে জল জমে যানজট, অফিস টাইমে দেরি এবং বিদ্যুৎ বিভ্রাট—সব মিলিয়ে নাজেহাল অবস্থার জন্য প্রশাসনকে আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে, না হলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে যেতে পারে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এমন নিম্নচাপ এবং ঘনঘন অস্বাভাবিক আবহাওয়ার প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে, যা কৃষি, পরিবেশ এবং আর্থসামাজিক জীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে। এখন দেখার বিষয়, এই ঝড়-বৃষ্টি কতোটা স্বস্তি আর কতোটা সমস্যা নিয়ে আসে বাংলার মানুষের জন্য। আপাতত সকলকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে, আবহাওয়ার আপডেট শুনে তারপরই বাহিরে বেরোন এবং স্কুল, অফিস বা মাঠে যাওয়ার সময় সঙ্গে ছাতা রাখুন এবং প্রয়োজন হলে নিরাপদ আশ্রয়ে যান। কাকভোরে কাকের ডাকে যেমন বৃষ্টির আগাম পূর্বাভাস পাওয়া যায়, তেমনি এখন সরকারি সতর্কবার্তাও শোনার সময়। কারণ, বাতাসের গতিবেগ আর প্রকৃতির রূপ যে কবে আচমকা বদলে যায়, তা বোঝা দায়।