The traditional Sholoana Durga Puja of Raniganj’s church neighborhood:শরতের আকাশে সাদা তুলোর মতো মেঘ, প্রখর সূর্যের মাঝে হঠাৎ বৃষ্টি, নতুন জামাকাপড়ের গন্ধ, আর ঢাকের আওয়াজে বাংলার আকাশ-বাতাস মুখরিত। দুর্গাপুজার এই সময়টা বাঙালির জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল মুহূর্তগুলোর মধ্যে একটি। শুধু কলকাতাই নয়, পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য শহরেও দুর্গাপুজার উন্মাদনা প্রবল, তার মধ্যে রানীগঞ্জ অন্যতম। আর রানীগঞ্জের গির্জা পাড়ার ষোলআনা দুর্গাপুজো সেখানে এক অনন্য ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।
রানীগঞ্জের এই দুর্গাপুজো শুধু একটি পুজো নয়, এটি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক নিদর্শন। এই পুজো এবার ৭৭তম বছরে পা দিয়েছে। যদিও আজকের দিনে থিম পুজোর জনপ্রিয়তা তুঙ্গে, তবে রানীগঞ্জের এই পুজো তার ঐতিহ্য ধরে রেখে প্রতিবারই মানুষকে আকর্ষণ করে। পুজোর এই ঐতিহ্যকে আরও মজবুত করেছে এলাকার সকল সম্প্রদায়ের মানুষের অংশগ্রহণ। হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান— সবাই মিলেই এই পুজোয় অংশ নেন। এই পুজো শুধু ধর্মীয় আচার নয়, এটি একটি সামাজিক মিলনক্ষেত্র, যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই সমানভাবে অংশগ্রহণ করেন।

ষোলোআনা দুর্গাপুজোর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এর সরলতা ও পবিত্রতা। আজকের দিনেও, যেখানে পুজোর আড়ম্বর বাড়ছে, সেখানে এই পুজো তার প্রাচীন রীতিনীতি অক্ষুণ্ণ রেখে চলছে। পুজো কমিটির অন্যতম সদস্য রবীন্দ্রনাথ বাদ্যকর জানিয়েছেন, “এই পুজোয় কোনও জাতি-ধর্মের ভেদাভেদ নেই। হিন্দু, মুসলিম, শিখ, খ্রিস্টান, সবাই মিলে এখানে মা দুর্গার আরাধনা করে। একত্রিত হয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করার এটাই মূলমন্ত্র।”
এই পুজোর আরেকটি আকর্ষণ হল প্রতিমা। প্রতিমাটি খুব সাদামাটা এবং ঐতিহ্যবাহী ধাঁচে তৈরি করা হয়, যাতে কোনও আধুনিকতার ছোঁয়া নেই। সেখানেই এর বিশেষত্ব। প্রতিমার চোখে এবং মুখের অভিব্যক্তিতে মায়ের করুণাময় চেহারা দেখা যায়, যা দর্শনার্থীদের মনে এক অদ্ভুত প্রশান্তির সৃষ্টি করে।
পুজোর সঙ্গে এলাকার মানুষের গভীর সংযোগ রয়েছে। গির্জা পাড়া এলাকাটি মূলত একটি শ্রমজীবী অধ্যুষিত এলাকা। এখানকার বাসিন্দারা সারা বছর নিজেদের জীবনযুদ্ধে লিপ্ত থাকলেও পুজোর সময় সবাই একসাথে হয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করেন। স্থানীয় বাসিন্দা অরূপ দত্ত বলেন, “এই পুজো আমাদের কাছে শুধু একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের গর্ব। এখানে সবাই মিলেমিশে পুজোর আনন্দ ভাগ করে নেই।”
এই পুজো শুধু আনন্দ বা ধর্মীয় আচার নয়, এটি এলাকার অর্থনীতির উপরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। পুজো উপলক্ষে অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও দোকানিরা তাদের রুটি-রুজির ব্যবস্থা করে থাকেন। পুজো কমিটির আরেক সদস্য অমল সিং বলেন, “আমরা প্রতিবছর স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা নিয়ে পুজোর সমস্ত আয়োজন করি। এটি আমাদের অর্থনীতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়।”
এই পুজো যতই ঐতিহ্যবাহী হোক না কেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কিছু পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে। পুজো কমিটি এখন ভাবছে, কীভাবে আরও বেশি মানুষকে এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত করা যায় এবং কীভাবে এই পুজোর ঐতিহ্য ধরে রেখে কিছু আধুনিকতার ছোঁয়া দেওয়া যায়। কমিটির সভাপতি বিপিন পাণ্ডে জানিয়েছেন, “আমরা চেষ্টা করছি পুজোয় আরও নতুন নতুন দিক যোগ করার, যাতে যুব প্রজন্মের আগ্রহও বাড়ে। তবে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে অক্ষুণ্ণ রাখার দায়িত্ব আমাদের।”

পুজোর সময় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসনও পূর্ণ সহযোগিতা করছে। প্রতি বছর পুলিশের কঠোর নজরদারির মধ্যে পুজোর আয়োজন করা হয়। নিরাপত্তার পাশাপাশি, সুষ্ঠু যানবাহন ব্যবস্থা এবং জরুরি পরিষেবা যাতে বাধাপ্রাপ্ত না হয়, তার দিকেও নজর রাখা হয়। রানীগঞ্জের পুলিশ কমিশনার জানিয়েছেন, “আমরা পুজো উপলক্ষে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। পুজো কমিটির সঙ্গে মিলিত হয়ে সমস্ত ব্যবস্থা নিয়েছি।”
রানীগঞ্জের ষোলোআনা দুর্গাপুজো স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে শুধুমাত্র একটি পুজো নয়, এটি তাদের জীবনের একটি অঙ্গ। তাদের শৈশবের স্মৃতি, তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, তাদের পরিচয়ের সঙ্গে এই পুজো জড়িয়ে রয়েছে। পুজো উপলক্ষে দূর-দূরান্ত থেকে আসা মানুষদের সঙ্গে এলাকার পুরনো বাসিন্দাদের পুনর্মিলন ঘটে। ছোটবেলার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, সন্ধ্যার পর ঢাকের তালে নাচ-গান, আর প্রসাদের স্বাদে মধুর মুহূর্ত তৈরি হয়।
এই পুজো একটি বৃহত্তর অর্থে এলাকার সংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। এখানকার মানুষ নিজেদের ঐতিহ্যকে গর্বের সঙ্গে ধরে রাখে এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে সেই ঐতিহ্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করে।