The mother of milk, Yogida, remains in the water for years.:-পূর্ব বর্ধমানের মঙ্গলকোটের এক প্রাচীন, রহস্যে মোড়া গ্রাম—ক্ষীরগ্রাম। এই গ্রামের প্রতিটি ধূলিকণায় মিশে আছে এক অদ্ভুত পবিত্রতা, যার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছেন এক দেবী, যাঁকে স্থানীয়রা বলেন—যোগ্যদা মা। এই যোগ্যদা মা সাধারণ কোনও দেবী নন, তিনি একান্ন শক্তিপীঠের অন্যতম, যাঁর বিশেষত্ব হল—তিনি সারা বছর থাকেন জলের তলায়, এবং শুধু বছরে একবার বিশেষ পূর্ণিমায় তাঁকে তুলে আনা হয় জল থেকে, হয় মন্দিরে বিশেষ পূজার আয়োজন। আর এই এক দিনের পুজোকে ঘিরেই হাজার বছরের ইতিহাস, রীতিনীতি, বিশ্বাস আর গ্রামীণ আবেগ মিশে তৈরি হয় এক অদ্বিতীয় ধর্মীয় উৎসব—যা শুধু একটি পুজো নয়, এক আবেগ, এক ঐতিহ্য।দীর্ঘকাল ধরেই এই পুজোর পেছনে রয়েছে নানা কাহিনি। লোকমুখে শোনা যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে বর্ধমানের রাজা কীর্তিচাঁদ রায় প্রায় আট বিঘা জমির ওপর তৈরি করেন এই মন্দির। তিনতলা বিশিষ্ট এই মন্দিরে দেবীর কোনও স্থায়ী মূর্তি থাকে না। শুধুমাত্র বছরে একবার—পুজোর দিন—জলের নিচে থাকা দেবীকে তুলে আনা হয় মন্দিরে, মহা আয়োজনের সঙ্গে পুজো হয়, ভক্তরা দর্শন লাভ করেন। বাকি সারা বছর মা থাকেন মন্দির সংলগ্ন এক গভীর দিঘির জলে—যার নাম ‘ক্ষীর দিঘি’। বহু পুরোনো বিশ্বাস, যেই মাটি ও জল দিয়ে মা তৈরি, সেই মাটি ও জলের মধ্যেই মায়ের বাস—এ যেন এক অপার্থিব আধ্যাত্মিক অনুভব।

এই পুজোর অন্যতম প্রাচীন রীতি হল বলিপ্রথা। আগেকার দিনে নরবলির প্রথাও চালু ছিল বলেই জনশ্রুতি। যদিও এখন সেই রীতি বিলুপ্ত, কিন্তু এখনও ছাগ ও মোষ বলি দেওয়া হয় এই পুজোয়। তবে সেই বলি আজ আর নৃশংসতার পরিচায়ক নয়, বরং বিশ্বাস, পরম্পরা ও পৈত্রিক আস্থার প্রতীক হিসেবেই দেখা হয়। এই বলিপ্রথা নিয়েও বহু তর্ক-বিতর্ক থাকলেও স্থানীয় বাসিন্দারা একে একটি পবিত্র ‘রীতি’ হিসেবেই দেখেন।এবছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বৃহস্পতিবার, বছরের সেই বিশেষ দিনে, দিঘির জলে ডুবন্ত যোগ্যদা মাকে তুলে আনা হয় বিশেষভাবে নির্মিত কাঠামোর মধ্যে। এরপর মন্দিরে স্থাপন করে শুরু হয় পুজো। সকাল থেকে ভোর পর্যন্ত চলে মন্ত্রোচ্চারণ, হোম-যজ্ঞ, বলিপ্রদান, অন্নভোগ, আরতি। শুধু মঙ্গলকোট নয়, পার্শ্ববর্তী গ্রাম, জেলা, এমনকি রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখ লাখ মানুষ ভিড় করেন এই মেলায়। যেন এক বার্ষিক তীর্থযাত্রার রূপ নেয় ক্ষীরগ্রাম।এই উৎসবকে কেন্দ্র করে বিশাল মেলা বসে, যেখানে হাতের কাজের সামগ্রী, গৃহস্থালির পণ্য, খেলনা, খাবার, এবং হস্তশিল্প বিক্রি হয়। ছেলেমেয়েদের মধ্যে সেই মেলার ঘুরে বেড়ানো, নাগরদোলা, ঝাঁপিং ও বাতাসা-চানাচুর খাওয়ার উৎসাহ আলাদা। এই মেলাকে ঘিরেই জীবিকা চলে অনেক স্থানীয় ব্যবসায়ীর, যাঁরা বছরের অপেক্ষায় থাকেন এই পুজো-সিজনের জন্য।
পুজো উপলক্ষে নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত কড়া। স্থানীয় বিধায়ক অপূর্ব চৌধুরীর নেতৃত্বে তৃণমূল দলের তরফ থেকে ছিল ভক্তদের জন্য জলের আয়োজন ও অন্নভোগ। প্রায় ১০ হাজার ভক্তকে বিনামূল্যে খাওয়ানো হয়। অপূর্ববাবু জানিয়েছেন, “এটা শুধু ধর্ম নয়, এটা আমাদের ঐতিহ্য। ক্ষীরগ্রামের পুজো মানে শুধু পুজো নয়, এটা হাজার হাজার মানুষের প্রাণের উৎসব। আমরা চেষ্টা করছি এই ইতিহাসকে আরও বড় পরিসরে বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে।”এদিকে জেলা প্রশাসন এবং পুলিশও এই উৎসবকে নির্বিঘ্ন করতে রাতদিন খেটেছেন। ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে নিরাপত্তা বলয়ের তৈরি, রাত্রিকালীন নজরদারি, সব ক্ষেত্রেই প্রশাসনের ভূমিকা প্রশংসনীয়। পুলিশ আধিকারিক অর্জুন দত্ত বলেন, “লক্ষাধিক ভক্তের আগমন, এত বড় মেলা—অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং ছিল। কিন্তু শান্তিপূর্ণভাবে দিনটি কাটানোর পর আমরা আশ্বস্ত।”এলাকার বাসিন্দারা বলেন, এই উৎসব তাঁদের জন্য শুধুই পূজা নয়—এ এক মিলনের মুহূর্ত, যখন পুরোনো বন্ধু, আত্মীয়স্বজনেরা একত্রিত হন। গ্রামেরই এক প্রবীণ বৃদ্ধা মাধবী ঘোষ বলেন, “আমি ছোটবেলা থেকে এই পুজো দেখে আসছি। আগে পা হেঁটে কত মানুষ আসত, এখন গাড়ি, বাস, বাইকেও আসে। কিন্তু মায়ের জল থেকে ওঠা আর চোখের সামনে পুজো হওয়া—এই অনুভব কোনোদিন বদলায় না।”

এই পুজোর আরও এক গভীর তাৎপর্য হলো—প্রকৃতির সঙ্গে দেবীর মেলবন্ধন। জলে বাস, মাটির মূর্তি, নির্দিষ্ট সময়ের পুজো—সব মিলিয়ে যেন এক আধুনিক পরিবেশবান্ধব ভাবনার প্রতীক হয়ে উঠেছেন যোগ্যদা মা। বহু পরিবেশপ্রেমীর মতে, এই পুজো নতুন প্রজন্মকে শেখাতে পারে কীভাবে ধর্ম, প্রকৃতি ও পরিবেশকে এক সুতোয় বাঁধা যায়।যোগ্যদা মায়ের পুজো ঘিরে ক্ষীরগ্রাম এখন এক ধর্মীয় পর্যটনের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। অনেক পর্যটন সংস্থা এখন এই সময়টাকে ঘিরে ‘রুরাল ট্যুরিজম’ প্রমোট করতে চাইছে। স্থানীয় ব্যবসা, হস্তশিল্প, লোকসংস্কৃতির প্রসারে এই উৎসব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে।শেষমেশ বলা যায়, যোগ্যদা মা শুধু জলে বাস করা এক দেবী নন, তিনি পূর্ব বর্ধমানের ক্ষীরগ্রামের হৃদয়। বছরজুড়ে তাঁর জলে থাকা, আর বিশেষ দিনে মন্দিরে ফিরে আসা যেন জীবনের এক গভীর দর্শন—আত্মগোপন ও আত্মপ্রকাশের চিরন্তন চক্র। এমনই এক দেবীর আরাধনায় মেতে ওঠে গোটা গ্রাম, আর এই মেলবন্ধন আমাদের শোনায় বাংলার মাটি, মানুষের ইতিহাস আর দেবী দর্শনের এক বিস্ময়কর গল্প।