The family worshiped Bauma as Chinmayi Kali : বাঁকুড়া জেলার মির্জাপুরের সাঁতরা পরিবারে প্রতিবারের মতো এবারও আয়োজন করা হয়েছে এক বিশেষ কালীপুজোর। এই পুজোর বিশেষত্ব হলো, এখানে দেবী কালীর একটি মাটির মূর্তি নয়, বরং পরিবারের বড় বৌমা হীরাবালা সাঁতরাকে মা কালীর রূপে পুজো করা হয়। প্রাচীন কালের এই রীতি এখনো বহাল রয়েছে এবং প্রতিবছর ভক্তদের ঢল নামে এই বাড়িতে। সাঁতরা পরিবারের এই বিশেষ পুজোটি শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি হয়ে উঠেছে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের একটি অংশ।
বাড়ির এই প্রথা প্রায় ৩৮ বছর ধরে চলছে। হীরাবালা দেবী নিজেই বলেন, “প্রায় ৩৮ বছর ধরে আমাকে দেবীর আসনে বসানো হয়। মায়ের ইচ্ছাতেই আমি পবিত্র ওই আসনে বসি। পুজোর সময় আমি বাস্তব জগত থেকে যেনও হারিয়ে যাই। অদ্ভুত এক অনুভূতি আমাকে ঘিরে রাখে।” হীরাবালা দেবী স্বীকার করেছেন, পুজোর সময় তাকে দেবী কালীর রূপে দেখার জন্য মানুষ দূরদূরান্ত থেকে আসেন। প্রতিবছর তিনি অনুভব করেন, যেন মা কালীর শক্তি তার মধ্যে প্রবাহিত হচ্ছে।
এই পুজোর ইতিহাস বেশ পুরোনো। পরিবারের পূর্বপুরুষরা এক সময় মাটির মূর্তিতে পুজো করতেন। তবে এক রাতে তাদের পূর্বপুরুষের স্বপ্নে নির্দেশ আসে, তারা সোনা বা অষ্টধাতুর মূর্তি পুজো করবেন। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে তা সম্ভব হয়নি, তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে একজন জীবন্ত নারীকেই পুজো করা হবে। সেই থেকে এই বিশেষ রীতি চলে আসছে।

সাঁতরা পরিবারের সদস্যরা জানান, প্রতি বছর কালীপুজোর দিন বাড়ির বড় বৌমাকে দেবীর আসনে বসানো হয়, যেখানে তার গলায় রক্ত জবার মালা ও কপালে রক্ত চন্দনের তিলক আঁকা হয়। পুজোর সময় স্থানীয় পুরোহিত তাকে পূজিতা করে। হীরাবালা দেবী বলেন, “এই পুজোর মাধ্যমে মা কালী যেন আমার মধ্যে প্রবাহিত হন এবং আমি মায়ের শক্তি অনুভব করি।”
স্থানীয় সমাজে এই পুজো একটি গুরুত্বপূর্ণ জায়গা অধিকার করেছে। মির্জাপুরের অন্যান্য পরিবারের সদস্যরাও এই পুজোতে অংশগ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসেন। সামাজিকভাবে এটি একটি মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে, যেখানে পরিবার, বন্ধুবান্ধব এবং প্রতিবেশীরা একত্রিত হন। এই ঐতিহ্য শুধু সাঁতরা পরিবারকেই নয়, বরং পুরো এলাকার মানুষের জন্য গর্বের বিষয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই পুজোর ছবি ও ভিডিওগুলো শেয়ার হওয়ার পর থেকে আরো বেশি সংখ্যক মানুষ এই অনুষ্ঠানে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও এই পুজোর গুরুত্ব বোঝেন এবং প্রতি বছর এটির প্রচারের জন্য সহায়তা করেন। প্রতিবছরই পুজো উপলক্ষে মেলার আয়োজন হয়, যেখানে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আয়োজন করা হয়। এটি এলাকার সাংস্কৃতিক জীবনকে আরও সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
তবে, এই ধরনের একটি পুজোর ভবিষ্যৎ কি? আজকের প্রজন্মের কাছে এই পুজোর মাহাত্ম্য কিভাবে পৌঁছানো যাবে, সে বিষয়ে চিন্তা করতে হবে। প্রযুক্তির যুগে অনেক কিছু বদলাচ্ছে, এবং ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এই ধারাকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে নতুন প্রজন্মের সাথে সম্পর্কিত হতে হবে। শিক্ষার মাধ্যমে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই প্রথাকে সংরক্ষণ করা সম্ভব।
এমনকি, এই পুজো শুধুমাত্র ধর্মীয় বা সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকেই নয়, বরং এটি নারীদের ক্ষমতায়নেরও একটি উদাহরণ। প্রাচীনকালে নারীদের স্থান সমাজে কোথায় ছিল, তা আমরা জানি। কিন্তু আজ, এই পুজোর মাধ্যমে নারীদের শক্তি এবং গুরুত্বকে চিহ্নিত করা হচ্ছে। নারীরা যে কেবল মাতৃত্বের প্রতীক নয়, বরং তারা দেবীর শক্তির রূপে চিহ্নিত হচ্ছে, এটি একটি শক্তিশালী বার্তা।
সাঁতরা পরিবারের এই আয়োজন আসলে আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ঐতিহ্য এবং আধুনিকতার সংমিশ্রণে আমরা একটি শক্তিশালী সমাজ গড়তে পারি। বৌমাকে পুজো করার এই বিশেষ পদ্ধতি সত্যিই এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করছে। আসুন, আমরা সকলে মিলে এই প্রথা সংরক্ষণ করি এবং আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিই।