The Biswathi World Heritage Site is being opened to the public!:-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান, বিশ্বভারতী, এখন ইউনেস্কো স্বীকৃত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। এতদিন পর্যটকরা শুধু রবীন্দ্রভবন, শিল্প ভবন কিংবা উপাসনাগৃহ ঘুরে দেখতে পেতেন, কিন্তু মূল আশ্রম প্রাঙ্গণ বা শিক্ষাঙ্গনের বহু অংশ পর্যটকদের জন্য ছিল নিষিদ্ধ। অবশেষে এই চিরাচরিত নিষেধাজ্ঞার বদল ঘটতে চলেছে। বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্য প্রবীর কুমার ঘোষ এক অভূতপূর্ব সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছেন—বিশ্বভারতীর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এবার পর্যটকদের জন্য পুরোপুরি খুলে দেওয়া হবে। জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহ বা আগস্টের প্রথম সপ্তাহ থেকেই চালু হতে চলেছে এই নতুন ব্যবস্থা, যা নিঃসন্দেহে বাংলার পর্যটন মানচিত্রে এক নতুন মোড় এনে দেবে।উপাচার্য প্রবীর ঘোষ জানিয়েছেন, প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে পর্যটকদের প্রবেশের সুযোগ করে দেওয়া হবে। প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংখ্যক পর্যটককে একটি নির্ধারিত ফি দিয়ে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবে এবং চারটি নির্দিষ্ট গাইড টিম তাঁদের পুরো হেরিটেজ জোন ঘুরিয়ে দেখাবেন। সেই সঙ্গে পর্যটকরা সংগীত ভবনে চলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করতে পারবেন। মূলত এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বিশ্বভারতীর ঐতিহ্যকে আরও বেশি করে জনগণের সামনে তুলে ধরতে চায় কর্তৃপক্ষ।এই ঘোষণায় যেমন পর্যটকদের মধ্যে উন্মাদনা তৈরি হয়েছে, তেমনই শান্তিনিকেতন এবং বোলপুরের স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মুখে এসেছে স্বস্তির হাসি। বহুদিন ধরে তাঁরা দাবি জানিয়ে আসছিলেন, পর্যটনের প্রসার ঘটাতে হলে বিশ্বভারতীর ভিতরে ঢোকার অধিকার পর্যটকদের দেওয়া উচিত। কারণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শুধু বাংলা নয়, গোটা বিশ্বের জন্য একটি ঐতিহ্যের নাম। সেই ঐতিহ্যের সুরক্ষিত সংরক্ষণ যেমন দরকার, তেমনই তার দর্শন সবার জন্য উন্মুক্ত করাও একধরনের সাংস্কৃতিক শিক্ষা।

বিশ্বভারতীর এক প্রাক্তন শিক্ষার্থী অনন্যা বসু বলেন, “আমি যখন পড়তাম তখনও পর্যটকদের নিয়ে নানা নিয়ম ছিল, অনেকে ঢুকতেই পারতেন না। অথচ আমাদের ক্যাম্পাসটা একটা জীবন্ত মিউজিয়াম। এটা যদি নিয়ম করে দেখানো হয়, তাহলে বিশ্বের সামনে শান্তিনিকেতনের সঠিক ভাবনাটা পৌঁছবে।”তবে এই সিদ্ধান্ত নিয়ে আপত্তিও উঠেছে। বিশেষ করে ছাত্র রাজনীতির ময়দান থেকে। তৃণমূল ছাত্র পরিষদের বিশ্বভারতী ইউনিটের সভাপতি রাহুল আচার্য বলেন, “বিশ্বভারতীর গরিমা ছিল এর নির্জনতা, শৃঙ্খলা ও আধ্যাত্মিক পরিবেশ। যেভাবে পর্যটকদের অবাধ প্রবেশাধিকার দেওয়া হচ্ছে, তাতে এই পরিবেশ নষ্ট হবে। বহিরাগতরা এলোমেলোভাবে প্রবেশ করলে ক্লাসঘর, পাঠচক্র, উপাসনাগৃহের পবিত্রতা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করা উচিত।” তিনি আরও জানান, “বিশ্বভারতী শুধু একটি ইউনিভার্সিটি নয়, এটি একটি আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক আশ্রম। এখানে আসা মানে শিক্ষার পাশাপাশি আত্মানুসন্ধানের সুযোগ। তাই এটিকে পর্যটনের নামে বিপণনের জায়গা করে তোলা চলবে না।”উপাচার্য অবশ্য আশ্বস্ত করেছেন, পর্যটকদের প্রবেশ থাকবে নিয়ন্ত্রিত এবং নজরদারির আওতায়। টিকিটের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সংখ্যক পর্যটককেই প্রবেশাধিকার দেওয়া হবে, এবং তাঁদের চলাফেরা নির্দিষ্ট গাইডলাইন মেনে হবে। তিনি আরও জানান, “বিশ্বভারতীর প্রতিটি স্থান রক্ষিত হবে, কোথাও পর্যটকদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিচরণ করার অনুমতি থাকবে না। আশ্রমের আবহাওয়া, শিক্ষার পরিবেশ—সব কিছুই সুরক্ষিত থাকবে।”
বিশ্বভারতীর এই ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ স্ট্যাটাস পাওয়ার পর থেকেই দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক, গবেষক, এবং সংস্কৃতিপ্রেমীদের মধ্যে আগ্রহ বেড়েছে শান্তিনিকেতন ঘুরে দেখার। ইউনেস্কোর ঘোষণা অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বিশ্বভারতীকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই ঘোষণার পরেই শুরু হয় পরিবেশ সংরক্ষণ ও সাংস্কৃতিক পরিকাঠামোর উন্নয়নের কাজ।পর্যটন দপ্তরের তরফে ইতিমধ্যেই বলা হয়েছে, বিশ্বভারতী দর্শন যদি সরকারি পর্যটন প্যাকেজে যুক্ত করা যায়, তাহলে শান্তিনিকেতনের পর্যটন একধাপ এগিয়ে যাবে। পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন নিগম সূত্রে জানা গেছে, নতুন পর্যটন নীতিতে শান্তিনিকেতনকে “Heritage-Experience Circuit” হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে রবীন্দ্রজীবন, বিশ্বভারতীর শিক্ষা, সোনাঝুরির হাট এবং স্থানীয় হস্তশিল্প সবকিছুকে একত্রে পর্যটকদের কাছে তুলে ধরা যায়।

এই উদ্যোগে সবথেকে উপকৃত হবেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। শান্তিনিকেতনের বাজরে হস্তশিল্পী, কাঠের কাজ করা কারিগর, কাঁথা সেলাই করা মহিলারা জানাচ্ছেন, “পর্যটক বাড়লে আমাদের বিক্রি বাড়বে। সবাই তো রবীন্দ্রভবনে ঢুকে চলে যান, এখন যদি পুরো ক্যাম্পাস ঘুরতে পান, তাহলে দোকানেও আসবেন, কথা বলবেন। এটাই আমাদের চাহিদা।”বিশ্বভারতীর এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ভবিষ্যতে দেশের অন্যান্য ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাকেন্দ্রগুলির জন্যও দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে বলেই মনে করছেন শিক্ষাবিদেরা। এক প্রাক্তন উপাচার্য জানান, “রবীন্দ্রনাথের আদর্শ ছিল জ্ঞান যেন কেবল ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে, জনসাধারণের মধ্যে পৌঁছায়। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে, আজকের এই পদক্ষেপ রবীন্দ্রচিন্তার সাথেই মানানসই।”তবে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সময় একাধিক চ্যালেঞ্জ আসবে। নিরাপত্তা, পরিচ্ছন্নতা, শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখা—এই সমস্ত বিষয়ে বিশ্বভারতী প্রশাসনকে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে। একবার যদি সুশৃঙ্খলভাবে শুরু হয়, তাহলে এই উদ্যোগ বিশ্বভারতীর ভাবমূর্তি যেমন মজবুত করবে, তেমনি শান্তিনিকেতন হবে বাংলা ও ভারতের গর্বের কেন্দ্রবিন্দু।