Temporary relief in tariff war : মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্ক নীতির জেরে যখন গোটা বিশ্বজুড়ে ব্যবসায়িক অস্থিরতা, ঠিক সেই সময়ে ট্রাম্পের এক ঘোষণায় সাময়িক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে ভারত সহ প্রায় ৭৫টিরও বেশি দেশ। ট্রাম্প জানিয়েছেন, এই দেশগুলোর উপর শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত আপাতত ৯০ দিনের জন্য স্থগিত রাখা হচ্ছে। এই ঘোষণায় ভারতের রপ্তানিকারকরা কিছুটা হলেও হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন, কারণ মার্কিন বাজারে পণ্য রফতানির উপর বাড়তি শুল্কের চাপ থেকে আপাতত মুক্তি মিলেছে। কিন্তু এই স্বস্তি সাময়িক, কারণ মার্কিন প্রশাসনের নীতি স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ভবিষ্যতে এমন পদক্ষেপ আবারও ফিরতে পারে, বিশেষ করে যেহেতু ট্রাম্প প্রশাসন “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতিতে বিশ্বাসী। তবে একই সঙ্গে চিনের উপর ট্রাম্প প্রশাসনের সিদ্ধান্ত একেবারে কড়া, যেখানে চিনা পণ্যের উপর ১২৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক কার্যকর করা হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে।

এই পদক্ষেপে একদিকে যেমন চিনের অর্থনীতি আরও চাপে পড়বে, তেমনই বিশ্ববাজারে তার প্রভাব পড়বে অবধারিত। কারণ চিন এক বিশাল উৎপাদক দেশ এবং সেখানে উৎপাদিত পণ্য সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়ে, ফলে এমন এক বড় অর্থনীতির উপর চাপ বাড়লে সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত ঘটে, যা বিশ্বের নানা দেশের ব্যবসায়িক ভারসাম্যে প্রভাব ফেলে। ভারতের ক্ষেত্রেও এই প্রভাব যে অল্প নয়, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বিভিন্ন সংস্থা ও বিশ্লেষকের বক্তব্যে। সিটি রিসার্চের সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, যদি এই শুল্ক যুদ্ধ স্থায়ী হয় এবং ভারতকেও পুরোপুরি তার আওতায় নিয়ে আসে, তাহলে ভারতের বার্ষিক রফতানিতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে প্রায় ৭০০ কোটি ডলার। বিশেষ করে গাড়ি নির্মাণ, কৃষিজ পণ্য এবং খাদ্যশস্য রফতানির উপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়তে পারে। উল্লেখযোগ্যভাবে, ভারতের মোট রফতানির একটা বড় অংশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যায়। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি, টেক্সটাইল, ওষুধ, কৃষিপণ্য—এই ক্ষেত্রগুলিতে ভারতের বাজার মার্কিন চাহিদার উপর অনেকটাই নির্ভরশীল। ফলে শুল্ক বৃদ্ধি হলে ভারতীয় কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতা করার ক্ষমতা কমে যাবে এবং তা সরাসরি কর্মসংস্থানে প্রভাব ফেলবে। গুজরাটের রাজকোটের এক ছোট গাড়ি যন্ত্রাংশ প্রস্তুতকারক রমেশ শর্মা জানান, “আমাদের ৬০ শতাংশ পণ্য মার্কিন বাজারে যায়। শুল্ক বাড়লে আমরাও আর সেই দামে পণ্য পাঠাতে পারব না। অর্ডার কমে গেলে আমাদের কর্মীদের চাকরি ঝুঁকিতে পড়বে।” অন্যদিকে মহারাষ্ট্রের একজন আম রফতানিকারক কিরণ মোহন্ত বলেন, “আমরা আমেরিকায় হাপুস আম পাঠাই বহু বছর ধরে। শুল্ক বাড়লে ক্রেতা কমে যাবে, কারণ ওদের কাছেও সস্তা বিকল্প আছে অন্য দেশ থেকে। ফলে কৃষকের ক্ষতি হবে।” এই ধরনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যায়, শুল্ক যুদ্ধ আসলে কেবলমাত্র দুই দেশের মধ্যেকার রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কৌশল নয়, এর বাস্তব প্রভাব পড়ে কোটি কোটি সাধারণ মানুষের জীবনে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতি বিশ্ব বাণিজ্যে দীর্ঘমেয়াদী অনিশ্চয়তা তৈরি করবে।
ভারতের অর্থনীতিবিদ দীপেন্দু ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, “এ ধরনের সিদ্ধান্ত বিশ্ব অর্থনীতিকে অস্থির করে তোলে। ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের পক্ষে এর ধাক্কা সামলানো কঠিন। দীর্ঘমেয়াদে কর্মসংস্থান হ্রাস, বিনিয়োগে অনিচ্ছা এবং বাজারে আস্থা হ্রাস পাবে।” অন্যদিকে রাজনৈতিক মহলেও এই পরিস্থিতি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। দিল্লি ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ডঃ অনন্যা বসু বলছেন, “ট্রাম্প প্রশাসনের এই সিদ্ধান্ত কৌশলগতভাবে চিনকে চাপে ফেলতে চায়, তবে ভারতকে জড়িয়ে ফেলা হলে তা কৌশলগত ভুল হবে, কারণ ভারত-আমেরিকা বাণিজ্যিক সম্পর্ক যথেষ্ট গভীর এবং দুই দেশেরই লাভজনক।” তবে এই মুহূর্তে যেটুকু স্বস্তি মিলেছে তা নিয়ে ভারতীয় বাণিজ্য মহল ধীরে ধীরে আবার নতুন করে পরিকল্পনা শুরু করেছে। ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, ৯০ দিনের এই মেয়াদে আলোচনার মাধ্যমে কিছু সমঝোতা সম্ভব হবে এবং ভারতকে স্থায়ীভাবে এই শুল্ক যুদ্ধের বাইরে রাখা হবে। তবে শেষ পর্যন্ত ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি কোন দিকে এগোয়, সেটাই দেখার। এই পরিস্থিতিতে সরকারকেও সক্রিয়ভাবে কূটনৈতিক আলোচনায় অংশ নিতে হবে যাতে ভারতীয় স্বার্থ রক্ষা করা যায়। অন্যদিকে, চিনের সঙ্গে ট্রাম্পের এই বাণিজ্য যুদ্ধ বিশ্ব বাজারে আরও চাপে ফেলতে পারে। অনেকেই বলছেন, চিন যদি পাল্টা পদক্ষেপ নেয় তবে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি, সরবরাহে ঘাটতি এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা দেবে। এই অস্থিরতা ভারতকেও ছুঁয়ে যেতে বাধ্য। এখন প্রশ্ন, এই সাময়িক স্বস্তি আসলেই কী দীর্ঘস্থায়ী হবে, না কি এটি কেবল মাত্র ঝড়ের আগের শান্তি? ভারতীয় ব্যবসায়ী সমাজ, কৃষক, রফতানিকারক থেকে শুরু করে আমজনতা সবাই সেই উত্তরের অপেক্ষায়। কারণ এক একটি নীতিগত পরিবর্তন যেমন কাগজে-কলমে বোঝা যায় না, তেমনই এর প্রভাব জীবনের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়ে। তাই এই শুল্ক যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত কোন দিকে এগোয়, সেটাই আগামী দিনের সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।