Teacher leaves for Ladakh with message of ‘world free from terror’:-পূর্বস্থলীর ছোট্ট গ্রাম রাজারপুর যেন হঠাৎ করেই দেশজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। কারণ, এখানকার এক সাধারণ গার্হস্থ্য বিজ্ঞান শিক্ষিকা, সুতপা সেন, আজ দেশের সামনে দাঁড় করিয়েছেন এক অসাধারণ উদাহরণ। সন্ত্রাসমুক্ত পৃথিবী গড়ার বার্তা নিয়ে সোমবার সকালে একটি স্কুটি চড়ে রাজারপুর থেকে রওনা দিয়েছেন তিনি ভারতের উত্তরের শেষ প্রান্ত লাদাখের উদ্দেশ্যে। তিনি একা, সঙ্গে নেই কোনও সংগঠন, নেই কোনও প্রচারের বাহারি আয়োজন—তবু তাঁর বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে হৃদয় ছুঁয়ে, কারণ সেটি সত্যিই সময়োপযোগী, জরুরি এবং নিঃস্বার্থ। সদ্য কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক সন্ত্রাসবাদী হামলায় ২৬ জন নিরীহ পর্যটকের প্রাণহানি দেশজুড়ে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতেই সুতপার এই যাত্রা যেন এক প্রতিবাদের ভাষ্য, যেখানে তিনি অস্ত্র নয়, বেছে নিয়েছেন ভালোবাসা, মানবিকতা ও শিক্ষা। তিনি শুধু শিক্ষক নন, তিনি সমাজের এক মননশীল কণ্ঠস্বর, যিনি চান ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সন্ত্রাসের নয়, শান্তির পথে হাঁটুক। সুতপার বক্তব্য অনুযায়ী,
“যখনই ছুটি পাই, তখনই মনে হয় এই সমাজের জন্য কিছু করতে হবে। এর আগেও আমি ‘সেভ গার্ল চাইল্ড’, ‘স্টপ ভায়োলেন্স এগেইনস্ট ওমেন’ ইত্যাদি বার্তা নিয়ে রোড ট্রিপ করেছি। তবে এবার পহেলগাঁওয়ের ঘটনার পর মনে হল, সন্ত্রাসবাদ এখন শুধু রাজনীতির বিষয় নয়, এটি এক মানবিক বিপর্যয়। তাই সন্ত্রাসমুক্ত পৃথিবীর জন্য রাস্তায় নামা ছাড়া আর কোনও পথ দেখছিলাম না।” তাঁর এই সাহসিকতার প্রশংসা করেছেন তাঁর বিদ্যালয়—বাঘনাপাড়া গার্লস হাই স্কুলের সহকর্মীরা। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জানান, “সুতপা ম্যাডামের মতো শিক্ষিকারা আমাদের গর্ব। তিনি শুধু ক্লাসরুমেই শিক্ষা দেন না, বাস্তব জীবনেও সমাজকে শিক্ষা দেন। তাঁর এই উদ্যোগ আমাদের সকলকে অনুপ্রাণিত করেছে।”
তাঁর এই যাত্রাপথে তিনি বিভিন্ন শহরে, গ্রামে, পর্যটন কেন্দ্রে থেমে থেমে মানুষের সঙ্গে কথা বলবেন, ছোট ছোট পথসভা করবেন, পোস্টার বিলি করবেন, সমাজকে বোঝাবেন—সহানুভূতি আর বোঝাপড়ার মধ্য দিয়েই সন্ত্রাস প্রতিরোধ সম্ভব। বর্তমানে সন্ত্রাসবাদ শুধুমাত্র কাশ্মীর নয়, আফগানিস্তান, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, নাইজেরিয়া সহ বিশ্বের নানা প্রান্তে সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপন্ন করছে। এই পটভূমিকায় একজন সাধারণ শিক্ষিকার এই ধরনের উদ্যম—যেখানে তিনি সংবাদ শিরোনামে আসার জন্য নয়, বরং সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই পথে নেমেছেন—তা নিঃসন্দেহে এক আশার আলো। সামাজিক মাধ্যমে ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়ে গেছে সুতপা সেনের যাত্রার ছবি ও ভিডিও। অনেকেই লিখেছেন, “এই হল সত্যিকারের দেশপ্রেম”। কেউ কেউ আবার তাঁকে ‘ভারতের মালালা’ বলতেও ছাড়েননি। বিশেষ করে শিক্ষিত মহলের একাংশ বলছেন, আজকের দিনে যখন দেশের কিছু অংশে বিদ্বেষ, ঘৃণা, এবং রাজনীতির কারণে বিভাজনের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, সেখানে একজন শিক্ষিকার এই মানবিক উদ্যোগ যেন এক বাতাসের ঝলক যা সমাজকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। তবে, এই যাত্রাপথ যে খুব সহজ হবে না, তা ভালোই জানেন সুতপা সেন। কঠিন পাহাড়ি রাস্তা, আবহাওয়ার বৈরিতা, একা পথ চলার ক্লান্তি—সবই থাকবে।
কিন্তু তবুও তিনি থামবেন না। কারণ, তাঁর লক্ষ্য শুধুমাত্র লাদাখ পৌঁছনো নয়, বরং প্রতিটি মানুষের মনে এই প্রশ্নটা জাগিয়ে তোলা—“সন্ত্রাস কীভাবে বন্ধ হতে পারে? আর আমরা সবাই কীভাবে সেই কাজে অংশ নিতে পারি?” পুলিশের পক্ষ থেকেও তাঁকে সম্পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। বর্ধমান জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, তাঁর এই যাত্রার নিরাপত্তা ও প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্রের বিষয়েও প্রশাসনিকভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। একদিকে যখন দেশের বিভিন্ন অংশে রাজনৈতিক দৌরাত্ম্য ও গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব নিয়ে সংবাদপত্রের পাতা ভরে উঠছে, তখন একজন শিক্ষিকার এই নিঃস্বার্থ, নির্জন, অথচ স্পষ্ট বার্তা—আমরা চাই না আরও কোনও শিশু বা মহিলা প্রাণ হারাক সন্ত্রাসের আগুনে—এই কণ্ঠস্বর সমাজের বিবেককে নাড়া দেয়। এই যাত্রা হয়তো কোনো সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে থামাতে পারবে না, কিন্তু এই যাত্রা নিশ্চয়ই আরও কয়েকজন মানুষকে ভাবতে শেখাবে, প্রতিবাদ করতে শেখাবে, কথা বলতে শেখাবে। সুতপা সেনের মতো মানুষরা প্রমাণ করেন, সমাজ বদলানোর জন্য মঞ্চে উঠে বক্তৃতা দেওয়া জরুরি নয়, বরং নিজের জীবনের একটা অংশ উৎসর্গ করাটাই প্রকৃত উদ্যোগ। আমরা ‘খবর বাংলা’র পক্ষ থেকে তাঁর এই যাত্রাপথে শুভেচ্ছা জানাই, এবং আশা করি ভবিষ্যতের শিক্ষকরা তাঁর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে সমাজকে গড়ার কাজে এগিয়ে আসবেন।