Students from the same school in the eighth grade : মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল মানেই বাংলার ঘরে ঘরে উৎসব। কারও চোখে জল, কারও মুখে হাসি—এই আবেগে ভরপুর দিনটি শুক্রবার আরও বিশেষ হয়ে উঠল বীরভূমের রামপুরহাট শহরের জন্য। কারণ এই বছর পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের মাধ্যমিক পরীক্ষায় অষ্টম স্থান দখল করেছে এক স্কুলেরই দুজন কৃতী ছাত্র—অরজিৎ মণ্ডল ও স্পন্দন মৌলিক। দুজনেই রামপুরহাটের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘জিতেন্দ্রলাল বিদ্যাভবন’-এর দশম শ্রেণির ছাত্র। তারা পেয়েছে ৬৮৮ নম্বর করে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা হাজার হাজার পরীক্ষার্থীর মধ্যে একই র্যাঙ্কে একই স্কুলের দু’জন ছাত্রের উঠে আসা নিঃসন্দেহে বিরল এবং গর্বের ঘটনা, যা নিয়ে এখন সরগরম গোটা বীরভূম।
শুক্রবার সকাল ৯টা নাগাদ মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি রামানুজ গঙ্গোপাধ্যায় সাংবাদিক সম্মেলনে মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করেন। তিনি জানান, এ বছর মোট পাশের হার ৮৬.৫৬ শতাংশ। ফেব্রুয়ারি মাসের ১০ তারিখে মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হয়ে শেষ হয়েছিল ২২ তারিখে। ৬৯ দিনের মধ্যেই ফল প্রকাশ করে নজির গড়ল পর্ষদ। প্রথম দশে রয়েছেন ৬৬ জন ছাত্রছাত্রী, যার মধ্যে অষ্টম স্থান অর্জন করেছেন মোট ১৬ জন। আর সেই তালিকায় রামপুরহাট জিতেন্দ্রলাল বিদ্যাভবনের দুই মুখ—অরজিৎ ও স্পন্দন।
অরজিৎ মণ্ডলের বাবা একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং মা গৃহবধূ। বাবা-মার স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে ছেলেটি দিনরাত পড়াশোনায় মন দিয়েছিল। অন্যদিকে স্পন্দন মৌলিকের বাবা স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং মা স্কুল শিক্ষিকা। পড়াশোনার পাশাপাশি স্পন্দন অত্যন্ত ভালো আঁকতে পারে বলে জানিয়েছেন তার শিক্ষিকারা। স্কুলের প্রধান শিক্ষক সমরেশ ভৌমিক বলেন, “এই সাফল্য শুধু অরজিৎ আর স্পন্দনের নয়, এটা আমাদের পুরো স্কুল পরিবারের গর্ব। দুজনেই চুপচাপ, শান্ত স্বভাবের, অথচ ক্লাসে বরাবরই সেরা। আমরা আশা করেছিলাম ভালো রেজাল্ট করবে, কিন্তু একই সঙ্গে রাজ্যের প্রথম দশে উঠে আসবে সেটা সত্যিই অভাবনীয়।”
অরজিৎ জানায়, “আমি প্রতিদিন নিয়ম করে পড়েছি। টিভি-স্মার্টফোন সব থেকে দূরে ছিলাম। বাবা-মা আর শিক্ষকদের সাহচর্যই আমাকে আজ এখানে পৌঁছে দিয়েছে।” স্পন্দনের কথায়, “আমি মূলত নিজে পড়ে বুঝি। কোনো টিউশন করিনি। স্কুলের শিক্ষকরা আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছেন। ওঁদের কাছেই আমি কৃতজ্ঞ।” দুই ছাত্রই ভবিষ্যতে বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করতে চায় এবং ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখে।

স্থানীয় মানুষ, প্রতিবেশী থেকে শুরু করে রামপুরহাট শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লায় এই খবর ছড়িয়ে পড়তেই মিষ্টি বিতরণ শুরু হয়ে যায়। স্কুলে পৌঁছাতেই দুই ছাত্রকে ফুল-মিষ্টি দিয়ে সংবর্ধনা জানান স্কুল কর্তৃপক্ষ। জেলাশাসক বলেন, “এই ধরণের কৃতী ছাত্রদের সরকারি ভাবে পুরস্কৃত করা হবে। ওদের পথ অনুসরণ করে আরও ছাত্রছাত্রী উৎসাহ পাবে।” জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শকও জানান, “এই রেজাল্ট শুধুই ব্যক্তিগত কৃতিত্ব নয়, এটা আমাদের জেলার শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতির প্রমাণ।”
শুধু রামপুরহাট নয়, গোটা রাজ্যের মানুষ এই খবর পেয়ে অভিভূত। অনেকে বলছেন, এই ঘটনা দেখিয়ে দিল প্রতিযোগিতার যুগে একসাথে চলার মানসিকতাও গড়ে তোলা যায়। পরীক্ষায় সাফল্য মানেই শুধুমাত্র নম্বর নয়, সহযোগিতা, মনোযোগ, পরিশ্রম আর পরিবার ও শিক্ষকদের সমর্থনের এক অনবদ্য মেলবন্ধন। আর সেই শিক্ষাটাই অরজিৎ আর স্পন্দনের দৃষ্টান্তের মাধ্যমে আজ উঠে এসেছে সকলের সামনে।
এছাড়াও মধ্যশিক্ষা পর্ষদের তরফে জানানো হয়েছে, আগামী বছর থেকে উত্তরপত্র মূল্যায়নের প্রক্রিয়া আরও দ্রুত ও স্বচ্ছ করার জন্য ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম বাড়ানো হবে। একইসঙ্গে ছাত্রদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর জোর দেওয়া হবে বলেও ঘোষণা হয়েছে। এই বছরের ফলাফল শুধুই পরিসংখ্যান নয়, এর মধ্যে রয়েছে বহু পরিবারের স্বপ্নপূরণ, বহু ছাত্রছাত্রীর আত্মপ্রত্যয়ের কাহিনি। আর এই গল্পে রামপুরহাটের জিতেন্দ্রলাল বিদ্যাভবনের অরজিৎ মণ্ডল ও স্পন্দন মৌলিক আজ হয়ে উঠেছে রাজ্যের কাছে অনুপ্রেরণার নাম।
এই ঘটনায় একদিকে যেমন বীরভূমের শিক্ষাঙ্গনে উৎসাহের সঞ্চার হয়েছে, তেমনই ভবিষ্যতে অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের জন্য এটি একটি মাইলস্টোন হয়ে থাকবে—যেখানে প্রতিযোগিতার মাঝেও বন্ধুত্ব, কঠোর অধ্যবসায় এবং গাইডেন্স কিভাবে একজন পড়ুয়াকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিতে পারে, তার এক উজ্জ্বল উদাহরণ। এখন সবার চোখ আগামী উচ্চমাধ্যমিক ও অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার দিকে, যেখানে হয়তো এই দুই কৃতী মুখ আবার রাজ্যের মুখ উজ্জ্বল করবে।