Special campaign ‘Chalo Kashmir’ to attract tourists to Kashmir:কাশ্মীর উপত্যকায় কয়েক সপ্তাহ আগেই ঘটে গিয়েছে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা—পাহেলগামে পর্যটকভর্তি বাসে জঙ্গি হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৬ জন নিরীহ মানুষ, যার মধ্যে বেশ কয়েকজন ছিলেন বাংলার বাসিন্দা। সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই এক অন্য স্বর, এক আশাবাদের সুর তুলে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে এক অভিনব প্রচারাভিযান—“চলো কাশ্মীর!” যার মূল লক্ষ্য হলো ভয় নয়, ভালোবাসা দিয়ে উপত্যকার অর্থনীতি, মানুষের জীবনযাত্রা এবং পর্যটন শিল্পকে পুনর্জীবিত করা। এই উদ্যোগের নেতৃত্বে রয়েছে TAAI অর্থাৎ ট্রাভেল এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া, যারা দেশজুড়ে ২৪০০-র বেশি সদস্য প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে এই অভিযানকে এক সামাজিক আন্দোলনের চেহারা দিয়েছে।
এই ক্যাম্পেইন শুধুমাত্র পোস্টার-ব্যানার আর সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং প্রত্যেকটি শহরে শহরে গিয়ে ট্রাভেল এজেন্সিগুলির মাধ্যমে পর্যটকদের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য নিয়মিত কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। কলকাতা শহর এই আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। এখানকার প্রায় ১০০টি এজেন্সি ইতিমধ্যেই এই ‘চলো কাশ্মীর’ অভিযানে নিজেদের নাম লিখিয়েছে, যারা প্রতি বছর গড়ে চার লক্ষেরও বেশি ঘরোয়া পর্যটককে বিভিন্ন স্থানে পাঠায়, তার মধ্যে অন্তত ৪০ হাজারের গন্তব্য হয়ে ওঠে কাশ্মীর। কলকাতার ‘সোনার বাংলা ট্র্যাভেলস’-এর কর্ণধার চন্দ্রশেখর দে বলেন, “মানুষ এখনও ভয় পাচ্ছেন, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমরা তথ্যভিত্তিক নিরাপত্তার কথা জানাচ্ছি। আমরা ভ্রমণ শুধু বিক্রি করছি না, একটা বার্তা দিচ্ছি—কাশ্মীর আবার হাঁটছে, আপনিও হাঁটুন তার পাশে।”
TAAI-এর প্রেসিডেন্ট জ্যোৎস্না সিং বলেন, “কাশ্মীরের পর্যটন মানে শুধু হোটেল বুকিং আর গাড়ির রিজার্ভেশন নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে লক্ষ লক্ষ মানুষের রুটি-রুজি—ডাল লেকের শিকারাওয়ালা থেকে পাহাড়ি গ্রামের কাশ্মীরি হস্তশিল্প বিক্রেতা, সবারই জীবন জুড়ে আছে পর্যটনে।” সেই কারণেই এই মিশন কেবল আর্থিক চ্যালেঞ্জ নয়, এক জাতীয় দায়িত্ব। তাঁরা জানিয়েছেন, “আমরা একে ক্যাম্পেইন বলছি না, বলছি এক মিশন—কাশ্মীরের হারিয়ে যাওয়া আত্মা ও অর্থনীতি ফিরিয়ে আনার মিশন।”
এই ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে ভ্রমণ এজেন্সিগুলি নতুন করে আকর্ষণীয় ট্যুর প্যাকেজ চালু করছে, যেখানে থাকছে হোটেল ডিসকাউন্ট, গাইডেড সিকিউর ট্যুর, এবং বিমান সংস্থাগুলির সঙ্গে যৌথভাবে আলোচনার মাধ্যমে ছাড়মূল্যে টিকিট বুকিং-এর সুবিধা। Indigo, GoFirst, SpiceJet-এর মতো সংস্থাগুলির সঙ্গে ইতিমধ্যেই কথাবার্তা চলছে যাতে দিল্লি-শ্রীনগর সেক্টরে হেভি ডিসকাউন্ট দেওয়া যায়।
কেন্দ্রীয় সরকারও এই প্রচেষ্টা থেকে পিছিয়ে নেই। ২০ মে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একটি উচ্চপর্যায়ের নিরাপত্তা পর্যালোচনা বৈঠক করেন এবং বলেন, “কাশ্মীর এখন সুরক্ষিত। নিরাপত্তা বাহিনী সম্পূর্ণ প্রস্তুত। আমাদের লক্ষ্য একটাই—যেকোনও মূল্যে পর্যটকদের নিরাপত্তা ও আত্মবিশ্বাস নিশ্চিত করা।” স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও জানান, “কোনও সন্ত্রাসবাদী শক্তি ভারতীয় পর্যটনকে থামাতে পারবে না। কাশ্মীর ভারতের গর্ব, ওটাকে আমরা জঙ্গিদের হাতে ছাড়ব না।”
এই মনোভাবের প্রতিফলন মিলেছে উপত্যকার মানুষের মনেও। শ্রীনগরের হোটেল ব্যবসায়ী আব্দুল হাকিম বলেন, “গত একমাসে বুকিং ৫০ শতাংশ কমে গিয়েছিল। এখন আবার কিছু কিছু ট্যুরিস্ট ফিরছেন, আমরা আশাবাদী।” আর এক হাউসবোট মালিক বাশির আহমেদ বলেন, “শুধু সরকার না, দেশের সাধারণ মানুষ যদি কাশ্মীরে এসে দাঁড়ান, তবেই সন্ত্রাসবাদিরা হারবে।”
পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালে জম্মু ও কাশ্মীর ভ্রমণ করেছেন ২.৩৬ কোটি পর্যটক, যার মধ্যে ৬৫ হাজারের বেশি ছিলেন বিদেশি পর্যটক। ২০২১ সালে যেখানে গড়ে দৈনিক ১৯০০ পর্যটক আসতেন, সেখানে এখন এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯৫০০-রও বেশি। এমনকি এপ্রিল মাসেই টুল টিকিট বিক্রির পরিসংখ্যান ছাড়িয়েছে অতীতের রেকর্ড। এমন প্রবণতা যদি চলতে থাকে, তবে ধারণা করা হচ্ছে ২০২৫ সালের মধ্যে কাশ্মীর ভারতের অন্যতম সেরা ঘরোয়া ট্যুরিজম হটস্পট হয়ে উঠবে।
এই পুরো আন্দোলন শুধু রাজনীতি নয়, এক মানবিকতার প্রচার। একটি প্রান্তিক অঞ্চলের অর্থনীতি, মানুষের আশা, ছোট ছোট ব্যবসা, আর সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে দাঁড়িয়ে গেছে পর্যটনের ভবিষ্যৎ। “চলো কাশ্মীর” তাই একটা স্লোগান নয়, এক প্রতিজ্ঞা—জঙ্গিদের চোখরাঙানিকে জবাব দিতে আমরা সবাই হাতে হাত ধরে পাহাড়ে যাবো, ডাল লেক ঘুরবো, কাশ্মীরি চা খাবো, আর বলবো—আমরা একসাথে আছি।