SILIGURI: শহর শিলিগুড়ি। ডুয়ার্স আর পাহাড়কে যুক্ত করা এক গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট। এখানকার বাসিন্দারা অনেকটাই গর্বিত তাঁদের শহরের পরিচ্ছন্নতা নিয়ে। দিনে দিনে উন্নত হচ্ছে পরিকাঠামো, রাস্তাঘাট, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষায় পুর নিগমের নেওয়া একাধিক পদক্ষেপ যেন শহরটাকে আরও সাজিয়ে তুলছে। কিন্তু সেই সুন্দর ছবির মধ্যেই চোখে পড়ছে এক করুণ চিত্র — নিউ জলপাইগুড়ি থানার চত্বরজুড়ে পরিত্যক্ত গাড়ির সারি, যা ক্রমেই পরিণত হচ্ছে শহরবাসীর স্বাস্থ্যঝুঁকির বড় কারণ হিসেবে। দিন যত যাচ্ছে, ততই এই ভাঙাচোরা, সিজ হওয়া গাড়িগুলি হয়ে উঠছে মশার প্রজননক্ষেত্র, বিষধর সাপ বা বিপজ্জনক কীটপতঙ্গের আশ্রয়স্থল আর বড়সড় স্বাস্থ্যঝুঁকির উৎস। বর্ষাকাল দরজায় কড়া নাড়ছে, আর এই সময়টাই হল ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়ার মতো রোগ ছড়িয়ে পড়ার আদর্শ সময়।
এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে দানা বাঁধছে একপ্রকার আশঙ্কা ও ক্ষোভ। এলাকার এক প্রবীণ বাসিন্দা অনন্ত রায় জানালেন, “থানার মত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এতগুলো পুরনো গাড়ি এভাবে ফেলে রাখা ঠিক নয়। একদিকে শহরের প্রত্যেক ওয়ার্ডে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চলছে, অন্যদিকে থানার ভিতরেই এমন নোংরা ছবি আমাদের হতাশ করে।” আরেক বাসিন্দা, স্কুল শিক্ষিকা সুদীপ্তা চক্রবর্তী বললেন, “আমার স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই এই পথ দিয়ে যাতায়াত করে। ওরা ভয় পায় ওই গাড়িগুলোর মধ্যে কিছু লুকিয়ে আছে কি না। শিশুদের নিরাপত্তার জন্য হলেও এগুলি সরানো দরকার।”
শুধু সাধারণ মানুষই নন, শিলিগুড়ি পুর নিগমও এই সমস্যা সম্পর্কে অবগত। পুর নিগমের জঞ্জাল ও স্যানিটেশন বিভাগের মেয়র পরিষদ মানিক দে বলেন, “এই ইস্যু নিয়ে সম্প্রতি পুরসভা ও পুলিশ প্রশাসনের এক যৌথ বৈঠকে আলোচনা হয়েছে। শিলিগুড়ির পুলিশ কমিশনার ও থানার আধিকারিকদের বিষয়টি জানানো হয়েছে। আমরা খুব তাড়াতাড়ি এগুলি অপসারণের জন্য পদক্ষেপ করব। শহরকে পরিষ্কার রাখার ব্যাপারে পুর নিগম যথেষ্ট সচেতন।”
শিলিগুড়ি মেট্রোপলিটন পুলিশের এক আধিকারিক অনানুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছেন, “এগুলি আদালতের নির্দেশে সিজ হওয়া গাড়ি। এগুলিকে সরানো আইনি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ না করা পর্যন্ত সম্ভব নয়। তবে আমরা পুর নিগমের সঙ্গে সমন্বয় করে দ্রুত কোনও বিকল্প খুঁজছি যাতে শহরের পরিবেশ দূষিত না হয়।”
তবে এখানেই শেষ নয় সমস্যা। পরিবেশবিদদের একাংশের মতে, পরিত্যক্ত গাড়ির ধাতব অংশ, তেল বা ব্যাটারি থেকে রাসায়নিক পদার্থ মাটিতে মিশে গিয়ে মাটির উর্বরতা ও আশেপাশের বাস্তুতন্ত্রের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে। পরিবেশপ্রেমী সংগঠন ‘সবুজ শিলিগুড়ি’র কর্ণধার মঞ্জুশ্রী সেন বলেন, “পরিত্যক্ত গাড়ি শুধু চোখের কাঁটা নয়, বরং একটা সময় পরে হয়ে দাঁড়ায় পরিবেশের উপর এক সরাসরি হুমকি। জঞ্জাল জমে থাকা মানেই কীটপতঙ্গের বাসা, যা থেকে নানা সংক্রমণ ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে।”
শহরের নিউ জলপাইগুড়ি এলাকা শুধু একটি থানা কেন্দ্রই নয়, বরং রেলওয়ে স্টেশন ও একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হোটেল, ট্রান্সপোর্ট হাবের জন্যও পরিচিত। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই অঞ্চলে যাতায়াত করেন। এইসব এলাকায় যদি পরিত্যক্ত গাড়ির কারণে এমন দৃশ্য তৈরি হয়, তাহলে তা শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়, বরং দৃশ্যদূষণের দিক থেকেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
শহর শিলিগুড়ির নানা প্রান্তে পুর নিগম ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ‘স্বচ্ছ অভিযান’ চালু করেছে। কন্যাশ্রী মোড়, বাঘাযতীন পার্ক, কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম এলাকা সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে সৌন্দর্যায়নের কাজও হয়েছে। তবুও এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি থানার প্রাঙ্গণে যদি পরিত্যক্ত, ভাঙা গাড়ি স্তূপ হয়ে পড়ে থাকে, তাহলে সেই চিত্র শহরের সৌন্দর্যের সঙ্গে বড়সড় বেমানান হয়ে ওঠে।
এখন প্রশ্ন উঠছে, তাহলে সমাধান কী? বিশেষজ্ঞদের মতে, সিজ হওয়া গাড়িগুলিকে নির্দিষ্টভাবে আইনি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করে নিকটবর্তী কোনো সরকারি বা পুরসভার সংরক্ষিত গ্যারাজে সরিয়ে নেওয়া যেতে পারে। সেখানে এগুলিকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য স্ক্র্যাপ হিসেবে পুনরায় প্রসেসিং করাও সম্ভব, যা পরিবেশবান্ধব ও আয় বৃদ্ধির উপায় হিসেবেও কাজে আসতে পারে।
সুতরাং, শহরের মানুষজন, পুর নিগম ও পুলিশ প্রশাসনের মিলিত প্রয়াসেই এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব। না হলে আগামী দিনে শুধু ডেঙ্গি বা ম্যালেরিয়ার প্রকোপই নয়, বরং এক অসুস্থ, নোংরা শহরের দৃষ্টান্ত হয়ে উঠবে এই এলাকা। শিলিগুড়ির মতো শহর, যেটি উত্তরবঙ্গের অন্যতম ব্যবসায়িক, পর্যটন ও পরিবহণ কেন্দ্র, তার পরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্যই হোক শহরবাসীর মূল অস্ত্র।