Monday, April 14, 2025
Google search engine
HomeUncategorisedশীতলা গ্রামে নববর্ষের আয়োজন

শীতলা গ্রামে নববর্ষের আয়োজন

Shitala River New Year’s practice : আসানসোলের উত্তর বিধানসভার অন্তর্গত শান্তিপূর্ণ ছোট্ট গ্রাম শীতলা, যেখানে প্রতিটি উৎসব যেন এক একটি আবেগের নাম, আর সেই আবেগই নতুন করে প্রাণ পেল এবারের পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে আয়োজিত এক ঐতিহাসিক ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। গ্রীষ্মের রোদ মুছে দিয়ে গ্রাম জুড়ে যেন ছড়িয়ে পড়েছে এক নতুন প্রভা—স্নিগ্ধতা, উৎসাহ আর ভক্তির এক মিশ্র অনুভব। গোপালপুর শিবমন্দিরের প্রাঙ্গণে ভক্তদের ভিড়, মন্দিরের ঘন্টাধ্বনি, কীর্তনের সুর আর ছেলেমেয়েদের উল্লাস মিলে পুরো গ্রাম যেন রূপ নিয়েছে এক জীবন্ত সাংস্কৃতিক মঞ্চে। পয়লা বৈশাখ শুধুই বাঙালির ক্যালেন্ডার বদলের দিন নয়, এই উৎসব বাঙালির হৃদয়ের সাথে গভীরভাবে জড়িত; ধর্ম, সংস্কৃতি, ইতিহাস আর সামাজিক বন্ধনের এক অপূর্ব সংমিশ্রণ। এবারে এই ঐতিহ্যকে আরও বেশি গভীরতা দিয়ে উপস্থাপন করল শীতলা গ্রামের মানুষ। তাদের এই প্রচেষ্টায় বিশেষ আলোকপাত করলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আইন ও শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক, যিনি নিজে উপস্থিত থেকে খোল ও করতাল তুলে দিলেন কীর্তন দলের সদস্যদের হাতে। তাঁর

বক্তব্যে তিনি বলেন, “বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা করা আমাদের সকলের দায়িত্ব। এই উদ্যোগ ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।” শীতলা গ্রামে এই নববর্ষ আয়োজন কেবল একটি অনুষ্ঠান নয়, এটি হয়ে উঠেছে এক সামাজিক আন্দোলনের রূপ, যেখানে ধর্মীয় ভাবগম্ভীরতা এবং লোকসংস্কৃতির অপূর্ব সমন্বয় প্রত্যক্ষ করেছে গ্রামবাসীসহ উপস্থিত অতিথিরা। সেখানকার স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান মমতা দাস জানালেন, “গ্রামের প্রতিটি মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা যেভাবে কীর্তনের তালিম নিচ্ছে, তা দেখে চোখ ভরে আসে। আমাদের প্রজন্ম যেন এই সংস্কৃতি ভুলে না যায়, সেটাই আমাদের প্রধান লক্ষ্য।” শুধু বড়রাই নয়, এই অনুষ্ঠানে শিশু-কিশোরদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। সকাল থেকেই তাঁরা মণ্ডপ সাজাতে, ফুলের মালা গাঁথতে, আর অতিথিদের স্বাগত জানাতে ব্যস্ত ছিল। শীতলা হাইস্কুলের শিক্ষক সৌমিত্র দে জানালেন, “আমরা বিদ্যালয় থেকেও ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ দিয়েছি অংশ নিতে। তাদের মধ্যে যে আগ্রহ দেখলাম, তাতে মনে হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকেই আমরা প্রস্তুত করতে পারছি।” এই আয়োজনের অন্যতম সংগঠক রতন পাল বললেন, “অনেকেই এখন পয়লা বৈশাখ মানেই শুধু খাবার, নতুন জামা আর শপিং ভাবেন। কিন্তু আমরা চাইছিলাম মানুষ আবার অনুভব করুক এই দিনের আসল তাৎপর্য—ধর্ম, সংস্কৃতি, একতা ও ভক্তির মেলবন্ধন।” সত্যিই, শীতলা গ্রামের এই ব্যতিক্রমী আয়োজন সেই হারিয়ে যাওয়া উপলব্ধিকেই ফিরিয়ে আনল। বহু দূর দূরান্ত থেকে ভক্তেরা এসেছিলেন শুধু এই অনুষ্ঠানটি প্রত্যক্ষ করতে। বাঁকুড়া, দুর্গাপুর, রানীগঞ্জ থেকেও বহু মানুষ আসেন এই কীর্তন উৎসবে অংশ নিতে। স্থানীয় ব্যবসায়ী শ্যামল চট্টোপাধ্যায় বললেন, “এই উৎসবের জন্যে গ্রামে যেন একটা নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। দোকানদার, কৃষক, গৃহবধূ—সবাই মিলে যেভাবে পরিকল্পনা করল, তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য।” পাশাপাশি, এই আয়োজন গ্রামবাসীদের মধ্যে এক নতুন সংহতির বার্তাও পৌঁছে দিয়েছে। ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ছিল গ্রামীণ মেলা, স্থানীয় হস্তশিল্পীদের প্রদর্শনী এবং ঐতিহ্যবাহী খেলা যেমন—বউ খেলা, কুমারী পূজা, হুল্লোড় প্রতিযোগিতা। আর এই সব কিছুর মধ্যেই স্পষ্ট ফুটে উঠেছে গ্রামের শিল্প-সংস্কৃতির উজ্জ্বল রূপ। শিশুদের জন্য আয়োজন করা হয়েছিল পটচিত্র আঁকা প্রতিযোগিতা

bitu+4

এবং লোকগীতি গাওয়ার আসর, যেখানে ছোট ছোট কণ্ঠে শোনা গেল “এসো হে বৈশাখ, এসো এসো” গানটি—যেন রবীন্দ্রনাথও আশীর্বাদ করে যাচ্ছেন এই প্রয়াসকে। এ ছাড়া গৃহবধূদের পক্ষে একটি ধামসা-মাদল নৃত্য প্রতিযোগিতাও আয়োজিত হয়, যেখানে মধ্যবয়সী মহিলারা অংশ নিয়ে সবাইকে চমকে দেন। আসানসোলের প্রাক্তন সাংস্কৃতিক আধিকারিক দীপ্তি সেনগুপ্ত বললেন, “এটি নিছকই এক গ্রামীণ আয়োজন হলেও এর গভীরতা আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছানোর মতো। সংস্কৃতি হচ্ছে শিকড়, আর এই শিকড়ই জাতিকে বাঁচিয়ে রাখে।” মঞ্চে সংগীত পরিবেশন করেন পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত কীর্তনশিল্পী উজ্জ্বল দাস ও তাঁর দল, যাঁরা বললেন, “এই ধরণের গ্রামীণ মঞ্চে গান গাইতে পেরে আমরা গর্বিত। এখানে যে ভালোবাসা পাওয়া যায়, তা শহরের বড় স্টেজেও পাওয়া যায় না।” পুরো অনুষ্ঠানটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয় ‘খবর বাংলা’ পত্রিকার ফেসবুক পেজে, যেখানে হাজার হাজার দর্শক একযোগে এই ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুভবের সাক্ষী হন। অনুষ্ঠান শেষে স্থানীয় প্রসাশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ভবিষ্যতে এই ধরনের আঞ্চলিক সংস্কৃতির উৎসব আরও বড় পরিসরে আয়োজনের চিন্তা ভাবনা চলছে এবং এর জন্য রাজ্য সরকার ও বিভিন্ন সামাজিক সংস্থা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে। এই আয়োজন নিঃসন্দেহে দেখিয়ে দিল, যখন গ্রামের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগিয়ে আসে, তখন তারা কেবলমাত্র একখণ্ড ভূমি নয়, বরং গোটা সমাজকেই জাগিয়ে তুলতে পারে। নববর্ষ মানে শুধু দিন বদল নয়, তা একটি মানসিক নবজাগরণ, আর সেটাই ঘটেছে শীতলা গ্রামে। এই আয়োজন ভবিষ্যতে হয়তো হয়ে উঠবে পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম সাংস্কৃতিক দৃষ্টান্ত, যেখানে ধর্ম আর সংস্কৃতি মিলেমিশে এক হয়ে ওঠে। এই আয়োজন যেন এক নতুন দিনের বার্তা—শিকড়কে ভুলে নয়, বরং তাকে আঁকড়ে ধরেই সামনে এগোনোই হোক আমাদের আগামী দিনের পথ।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments