Sabuj Sathi accused of taking money in exchange for bicycle : সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রাম পাঁচুয়াখালি, চারদিকে জঙ্গল আর কাঁদামাটির পথ, বিদ্যুৎ-ইন্টারনেট যেখানে আজও অনেকটাই স্বপ্নের মতো, সেখানেই ছোট্ট একটি স্কুল—পাঁচুয়া খালি হাই স্কুল, এই স্কুলেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বপ্নের প্রকল্প ‘সবুজ সাথী’র সাইকেল বিতরণে উঠল দুর্নীতির অভিযোগ, আর তাতেই রাজ্য রাজনীতিতে তৈরি হয়েছে প্রবল চাঞ্চল্য। কথা ছিল, নবম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীদের মুখ্যমন্ত্রীর উপহার হিসেবে বিনামূল্যে দেওয়া হবে সবুজ রঙের নতুন সাইকেল, যাতে ছাত্রছাত্রীরা দূরের রাস্তা হেঁটে না এসে এই সাইকেলেই স্কুলে যেতে পারে, ক্লাস মিস না হয়, আর পড়াশোনা ছেড়ে না দিতে হয়। কিন্তু বাস্তব ছবিটা একেবারেই আলাদা—ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে
নেওয়া হচ্ছে ১০০ টাকা করে! এমনই চিত্র ধরা পড়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার এই স্কুলে। অভিযোগ, স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম নিজের সিদ্ধান্তেই বলেছেন, “সাইকেল নিতে হলে দিতে হবে ১০০ টাকা আর সঙ্গে আনতে হবে এক কপি ছবি।” অভিভাবকরা তীব্র ক্ষোভ জানিয়েছেন, কেউই এই টাকার রসিদ পাননি, অথচ টাকা না দিলে সাইকেল মেলেনি! ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই বলেছে, “স্যার বকবে, তাই টাকা দিতে বাধ্য হয়েছি।” তাদের কথায়, “সবাই দিচ্ছে তাই আমরাও দিলাম, না দিলে স্যার বলেছে সাইকেল দেওয়া হবে না।” অভিভাবক শাবানা সেখ বললেন, “মেয়েটা পায়ে হেঁটে অনেক দূর থেকে আসে, ভাবলাম সাইকেল পেলে সুবিধা হবে, এখন দেখছি ১০০ টাকা না দিলে কিছু মিলবে না! এটা কেমন প্রকল্প?” মনোয়ারা পেয়াদা, আরও এক অভিভাবক বলেন, “সরকার তো বলেছে ফ্রি সাইকেল দেবে, তাহলে টাকা কেন নিচ্ছে স্কুল?” অন্যদিকে প্রধান শিক্ষক মোঃ জাহাঙ্গীর আলম সংবাদমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেছেন, “জামতলা থেকে গাড়ি করে সাইকেল আনাতে খরচ হয়, সেই খরচটাই ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে। সরকারি নিয়ম নেই, কিন্তু আমাদের তো কিছু করতেই হয়।” অথচ এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কোনরকম ‘জেনারেল মিটিং’ ছাড়াই, স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সঙ্গেও আলোচনা ছাড়াই। প্রশ্ন উঠছে—তাহলে কি ব্যক্তিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকারি প্রকল্পে টাকা আদায় করা হচ্ছে? স্থানীয়দের বক্তব্য, “এই এলাকায় বহু পরিবার দিন আনে দিন খায়, তারা ১০০ টাকা দিতে বাধ্য হলে সেটা চরম অবিচার। সরকারের উপহার যদি কিনে নিতে হয়, তাহলে সাধারণ মানুষের আর কী ভরসা থাকে?” সাইকেল হাতে পেয়েও অনেকে খুশি নয়, কারণ এটা পাওয়ার পেছনে আছে অপমান আর অন্যায়। ঘটনাটি সামনে আসতেই বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন কুলতলী বিধানসভার বিধায়ক গণেশচন্দ্র মন্ডল। তিনি বলেছেন, “সবুজ সাথী মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প, সেখানে একটাকাও নেওয়া উচিত নয়। আমি প্রশাসনের সঙ্গে কথা

বলে বিষয়টি খতিয়ে দেখব, ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে নেওয়া টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে।” বিধায়কের এই প্রতিশ্রুতি সাময়িক স্বস্তি দিলেও এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভ কিন্তু অনেকটাই জমে রয়েছে। অনেকেই বলছেন, “এভাবে যদি স্যাররা টাকা তুলে নেন, তাহলে কালকে আরও কিছু চাইবে—পেন খরচ, খাতা খরচ, বাচ্চাদের ঝাড়ু কেনা খরচ!” জানা গিয়েছে, ২০১৫ সাল থেকে রাজ্য সরকার এই ‘সবুজ সাথী’ প্রকল্প চালু করে, যার মাধ্যমে নবম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের সরকার বিনামূল্যে সাইকেল দেয়। এখনও পর্যন্ত রাজ্যে ১ কোটিরও বেশি ছাত্রছাত্রী এই সাইকেল পেয়েছে। প্রকল্পটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও প্রশংসিত হয়েছে। ২০২১ সালে এই প্রকল্প ইউনাইটেড নেশনস-এর Public Service Award-ও পেয়েছে। কিন্তু এমন এক স্বপ্নের প্রকল্পেই যদি দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে, তাহলে প্রশ্ন উঠবেই—এই স্বপ্ন কি তাহলে হাতবদল হয়ে যাচ্ছে প্রভাবশালীদের লোভে? স্থানীয় কিছু শিক্ষক ও শিক্ষাবিদদের বক্তব্য, “এই ধরনের ঘটনার ফলে গোটা রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থার ভাবমূর্তি নষ্ট হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরা মনে করছে, সরকারি জিনিস মানেই ঘুষ দিয়ে কিনতে হবে, যা একদমই উচিত নয়।” আরেকটি আশঙ্কা দেখা দিয়েছে—এই ঘটনা যদি অন্য জেলাতেও ঘটতে থাকে? যদি অন্যান্য স্কুলেও প্রধান শিক্ষক বা অন্য কেউ গাড়ি ভাড়া, ক্যারিয়ার চার্জ, বা অন্য নামে টাকা নেওয়া শুরু করেন? তখন কি পুরো প্রকল্পটাই প্রশ্নের মুখে পড়বে না? প্রশাসনের তরফ থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও অফিসিয়াল বিবৃতি মেলেনি, তবে জেলা শিক্ষা আধিকারিক সূত্রে জানা যাচ্ছে, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু হয়েছে। তাঁরা জানিয়েছেন, “সরকারি প্রকল্পে কোনও টাকা নেওয়ার নিয়ম নেই, যদি এমন কিছু ঘটে থাকে, তবে তা একেবারেই অনৈতিক।” এদিকে সোশ্যাল মিডিয়াতেও এই ঘটনা নিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল আলোচনা। “#সবুজসাথী_ঘুষচক্র”, “#ছাত্রদের_সাইকেল_বিক্রি”, “#জাহাঙ্গীর_স্যার_জবাব_চাই”, “#মমতার_স্বপ্নে_চোর”—এই রকম নানা হ্যাশট্যাগে ভরে উঠেছে ফেসবুক, টুইটার। কেউ লিখেছেন, “সবুজ সাথী সাইকেল গরিব ছেলেমেয়েদের অধিকার, সেটা বিক্রি করলে মাথা নত করতে হয়”, কেউ আবার বলছেন, “জেলার প্রশাসন কি ঘুমিয়ে আছে? এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।” একদিকে স্কুলের অভিভাবকদের চিন্তা, অন্যদিকে ছাত্রছাত্রীদের মুখে হতাশা—এই দুই মিলিয়েই তৈরি হয়েছে একটা চাপা ক্ষোভ, যার রেশ শুধু পাঁচুয়া খালি নয়, ছড়িয়ে পড়ছে গোটা দক্ষিণ ২৪ পরগনায়। এখন দেখার বিষয়, প্রশাসন কীভাবে এই ঘটনাকে হ্যান্ডেল করে, আর ওই ১০০ টাকার ‘ভূত’ সত্যিই স্কুলের দেয়াল ছেড়ে পালিয়ে যায় কিনা।