Russia’s investment in Pakistan is Rs 22,000 crore : পাকিস্তানের করাচি শহরের বুক জুড়ে যে ধাতব কারখানার নতুন জীবন শুরু হতে চলেছে, তার পেছনে আছে রাশিয়ার এক সুবিশাল অর্থনৈতিক হাতছানি—২২ হাজার কোটি টাকার (২.৬ বিলিয়ন ডলার) বিনিয়োগ। যা শুধু পাকিস্তানের ধুঁকতে থাকা ইস্পাত শিল্পকেই নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক মানচিত্রকেও নাড়িয়ে দিয়েছে। এই বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করেন রাশিয়ার প্রতিনিধি ডেনিস নজরুফ, যিনি পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনার পর এই প্রকল্পের রূপরেখা প্রকাশ করেন। করাচিতে যে স্টিল প্ল্যান্টটি নির্মিত হতে চলেছে, তা মূলত ১৯৭০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তায় গঠিত এক পুরনো প্রকল্পের পুনর্জন্ম। ২০১৫ সাল থেকে এই প্ল্যান্ট বন্ধ হয়ে পড়েছিল নানা প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে, যা পাকিস্তানের অর্থনীতিতে এক বড় ধাক্কা হিসেবে ধরা দেয়। এবার রাশিয়া অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, মেশিনারি এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়ে এই প্ল্যান্টকে পুনরায় সচল করতে চলেছে।
এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য একেবারেই স্পষ্ট—পাকিস্তানের বার্ষিক ১১.২ মিলিয়ন মেট্রিক টন ইস্পাতের ঘাটতি পূরণ করা, যার জন্য ইসলামাবাদকে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়। পাকিস্তানের অর্থনীতি যেখানে বারবার টালমাটাল, সেখানে এই প্রকল্প শুধু এক অর্থনৈতিক আশার আলো নয়, এক রাজনৈতিক কৌশলেরও প্রতিফলন। পাকিস্তানের বাণিজ্য মন্ত্রী গহর ইকবাল জানিয়েছেন, “এই প্রকল্প চালু হলে পাকিস্তানের ইস্পাত শিল্পে বিপ্লব ঘটবে। আমাদের দেশের মানুষের জন্য নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। অন্তত ২০ হাজার মানুষের জন্য নতুন চাকরি তৈরি হবে, যার প্রত্যক্ষ উপকার পাবে করাচি এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা।”

তবে, এই বিনিয়োগের পেছনের গল্পটা এত সহজ নয়। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাশিয়ার এই বিনিয়োগ শুধু অর্থনৈতিক লাভের জন্য নয়, বরং আফগানিস্তান ও দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের কৌশলগত প্রভাব বাড়ানোর অংশ। আফগানিস্তান থেকে আমেরিকার প্রস্থান এবং চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের পাশাপাশি রাশিয়ার এই বিনিয়োগ স্পষ্টভাবে দক্ষিণ এশিয়ার কৌশলগত ভারসাম্য বদলাতে পারে। বিশ্লেষক আরিফ জামাল বলেন, “এই বিনিয়োগ রাশিয়ার এক বড় চাল। পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে গিয়ে তারা আসলে নিজেদের প্রভাবের বৃত্ত তৈরি করছে। এর মাধ্যমে চীন ও ভারতের কৌশলগত প্রভাবের মধ্যে নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়া হচ্ছে।”
অন্যদিকে, ভারতের কূটনৈতিক মহলে এই বিনিয়োগ নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। কারণ, পাকিস্তান ও রাশিয়ার এই নতুন অর্থনৈতিক সখ্যতা ভারত-রাশিয়া সম্পর্কের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে ভারত সরকার এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি, তবে পর্দার আড়ালে কূটনৈতিক স্তরে যে আলোচনায় উত্তাপ রয়েছে, তা স্পষ্ট। এক প্রাক্তন ভারতীয় কূটনীতিক সঞ্জয় মিত্র জানিয়েছেন, “রাশিয়া ও পাকিস্তানের এই কাছাকাছি আসা ভারতের জন্য সতর্কতার সঙ্কেত। ভারতকে এখন দক্ষিণ এশিয়ায় নিজের অবস্থান নতুন করে হিসাব করে দেখতে হবে।”
তবে পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের জন্য এই বিনিয়োগ এক নতুন আশার কথা। করাচির স্থানীয় বাসিন্দা নাজিম খান বলেন, “বছরের পর বছর এই প্ল্যান্ট বন্ধ পড়ে ছিল। চারপাশে ধুলো জমা মেশিন, মরিচা ধরা লোহার পাত দেখে কষ্ট হতো। এখন আবার কাজ শুরু হবে শুনে মনে হচ্ছে আমাদের জীবনও নতুন করে শুরু হবে।” করাচির ব্যবসায়ী মহলও এই বিনিয়োগে স্বস্তি প্রকাশ করেছে। মহম্মদ রিয়াজ, এক স্থানীয় ব্যবসায়ী বলেন, “আমরা ইস্পাত আমদানির উপর নির্ভরশীল ছিলাম। দাম বেড়ে যেতেই থাকত। এখন যদি দেশে উৎপাদন হয়, তাহলে আমাদের খরচ কমবে।”
রাশিয়ার এই বিনিয়োগ শুধু করাচির ইস্পাত কারখানা নয়, বরং নতুন করে জ্বালানি প্রকল্প, কৃষি মডার্নাইজেশন এবং অবকাঠামো উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিও বয়ে আনছে। ফলে, পাকিস্তানের অর্থনীতির জন্য এটি এক নতুন দিকচিহ্ন হতে পারে। তবে একইসঙ্গে এই বিনিয়োগ ঘিরে কিছু শঙ্কাও রয়েছে। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থান কতটা স্থিতিশীল, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। পাশাপাশি, পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতিও এই প্রকল্পের ভবিষ্যতের উপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, রাশিয়ার এই ২২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ পাকিস্তানের জন্য এক অর্থনৈতিক লাইফলাইন, কিন্তু এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক জটিল কূটনৈতিক সমীকরণ। করাচির ইস্পাত কারখানার চিমনি থেকে ধোঁয়া উঠতে শুরু করলে কেবল পাকিস্তানের অর্থনীতিই নয়, দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির মানচিত্রও কিছুটা হলেও বদলে যাবে। প্রশ্ন একটাই—এই বিনিয়োগ কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে, আর কতদিন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য টিকে থাকবে এই রাশিয়া-পাকিস্তান অর্থনৈতিক বন্ধুত্বের সেতু।