Roadblock battle in Panagarh:আজ পানাগড় মোড়ের দৃশ্যটা যেন সিনেমার মতো—চারদিক ধোঁয়ায় মুড়ে গেছে, রাস্তায় জ্বলছে টায়ার, মুখে রাগ, হাতে প্ল্যাকার্ড আর গলায় স্লোগান, “মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই!”—এইভাবেই রাজপথ দখল নিয়েছিল বিজেপি কর্মীরা। ঘটনাটির পেছনে রয়েছে এক বিস্ফোরক সিদ্ধান্ত, যেটা শুধু শিক্ষা দপ্তরকেই নয়, কাঁপিয়ে দিয়েছে গোটা রাজ্যের প্রশাসনিক ভিত। ২০১৬ সালে এসএসসি পরীক্ষা নিয়ে যে দুর্নীতির অভিযোগ উঠে এসেছিল, তার ফলশ্রুতি এতটা গভীর হবে, তা হয়তো কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক নির্দেশ অনুযায়ী, ২০১৬ সালের এসএসসি নিয়োগে যারা কাজ পেয়েছিলেন, সেই প্রায় ২৬ হাজার শিক্ষকের চাকরি বাতিল হয়েছে। আর এতেই রাজ্যজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে এক তীব্র রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্তেজনা, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে পানাগড়ে। কাঁকসার বিজেপি কর্মীরা আজ দুপুর ১২টা নাগাদ কাঁকসার মিনি বাজার থেকে মিছিল করে এসে পানাগড় মোড় গ্রাম রাজ্য সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। রাস্তার উপর টায়ার জ্বালানো হয়, জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক, যান চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ—যেমন স্কুলগামী ছাত্রছাত্রী, অফিস যাত্রীরা, জরুরি পরিষেবার কাজে যাতায়াতকারী মানুষজন—সবাই আটকে পড়েন। একটি অ্যাম্বুলেন্সও বেশ কিছুক্ষণ আটকে ছিল, যদিও পরে পুলিশ হস্তক্ষেপে সেটিকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ঘটনাস্থলে দ্রুত পৌঁছে যায় কাঁকসা থানার বিশাল পুলিশবাহিনী। তাঁরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন, বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিয়ে যান চলাচল স্বাভাবিক করেন। তবে ততক্ষণে স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভ জমে গেছে। এক স্থানীয় বাসিন্দা মীনাক্ষী দে বললেন, “আমরা তো পড়ে আছি দুই দলে। সরকার চাকরি কেড়ে নিচ্ছে, আবার বিরোধীরা রাস্তায় নামছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের কি কোনো দিক আছে?” অন্যদিকে, বিজেপির স্থানীয় নেতা রঞ্জন ঘোষ বলেন, “এই অবিচারের প্রতিবাদে আমরা পথ অবরোধ
করেছি। ২৬ হাজার পরিবার আজ পথে বসেছে। মুখ্যমন্ত্রীকে এর জবাব দিতেই হবে।” তবে সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়নি, যদিও শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু বলেছেন, “আমরা আইনের দিকটি বিবেচনা করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।” সূত্র মারফত জানা যাচ্ছে, রাজ্য সরকার শীঘ্রই এই বিষয়ে একটি রিভিউ পিটিশন দায়ের করতে চলেছে সুপ্রিম কোর্টে। তবে শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন চরম অনিশ্চয়তা। অনেক শিক্ষকই আছেন যাঁরা বিগত ৭-৮ বছর ধরে স্কুলে নিয়মিত ক্লাস নিচ্ছেন, ছাত্রছাত্রীদের গড়ে তুলেছেন, এবং তাঁদের জীবনের প্রধান অবলম্বন ছিল এই চাকরি। এখন সেই অবলম্বন হারিয়ে অনেকেই ভেঙে পড়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়েও চলছে ব্যাপক চর্চা—কেউ বলছেন দুর্নীতির ফলাফল, কেউ বলছেন ন্যায়বিচার, আবার কেউ বলছেন, রাজনীতির খেলা। রাজনৈতিক বিশ্লেষক অনির্বাণ সেন বললেন, “এই রায় এবং তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া রাজ্যের রাজনীতিতে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলবে। বিশেষত যাঁরা চাকরি হারালেন, তাঁদের পরিবারের ভোটাররা আগামী দিনে কাকে সমর্থন করবেন, তা এখন থেকেই ভাবা উচিত রাজ্য সরকারের।” এদিকে শিক্ষক মহলে প্রবল উদ্বেগ। অনেকেই ইতিমধ্যেই আন্দোলনে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিছু জায়গায় অনশন শুরু হয়েছে। শিক্ষক অনুপ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, “আমি কোনো টাকার বিনিময়ে চাকরি পাইনি। আমি সৎ পথে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেছি। এখন আমাকে যদি চাকরি হারাতে হয়, তবে তা শুধু আমার নয়, আমার গোটা পরিবারের জীবন শেষ।” এই ঘটনার প্রভাব শুধু রাজনৈতিক নয়, সামাজিক দিক থেকেও যথেষ্ট গুরুতর। রাজ্যে শিক্ষক সংকট আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। নতুন করে নিয়োগ কত তাড়াতাড়ি সম্ভব হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। আর এই অনিশ্চয়তা আর বঞ্চনার পরিবেশে সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন—“আসলে আমরা কার উপর ভরসা করব?” এখন দেখা যাক, রাজ্য সরকার কী পদক্ষেপ নেয় এবং আদালতের পরবর্তী রায়ে কী নির্দেশ আসে। তবে আজকের পানাগড়ের এই বিক্ষোভ একটিই কথা স্পষ্ট করে দিয়েছে—এই সমস্যা এখন আর কেবল আদালতের নথিতে সীমাবদ্ধ নয়, এটি এখন রাস্তায়, মানুষের মনের মধ্যে, এবং রাজনীতির কেন্দ্রে ঢুকে পড়েছে।