Residents of flooded banks fear floods in the mountains:নদীর পাড়ে বাড়ি মানেই বছরভর উদ্বেগ, তবে সেই উদ্বেগ যখন বাস্তবে পরিণত হয়, তখন তা হয়ে ওঠে রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া এক দুর্বিষহ যন্ত্রণা। এমনই পরিস্থিতির মুখোমুখি এখন উত্তরবঙ্গের জলঢাকা নদীর পাড়ের মানুষজন, বিশেষ করে বারোঘরিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত পাটকিদহ ও ডাঙ্গাপাড়া এলাকার প্রায় আড়াইশোটি পরিবার। পাহাড়ে লাগাতার বৃষ্টির ফলে ফুলেফেঁপে উঠেছে জলঢাকা নদী, আর সেই সঙ্গে নতুন করে শুরু হয়েছে ভাঙন। নদী এখন এতটাই কাছাকাছি চলে এসেছে যে অনেকের বাড়ির উঠোন ছুঁয়ে যাচ্ছে জল।
কথায় আছে, “নদীর পাড়ে বাস, চিন্তা বারোমাস”, আর সেটাই যেন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন এই এলাকার মানুষজন। গ্রামের বাসিন্দা চঞ্চলা সরকার বললেন, “আগে নদী ছিল অনেক দূরে, কিন্তু এখন নদীর গতি এমন হয়েছে যে ঘরের সামনেই বয়ে চলেছে। রাতে ঘুম হয় না, বৃষ্টি হলে মনে হয় এই বুঝি নদী সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।” গ্রামেরই আরেক বাসিন্দা রামকৃষ্ণ বর্মণ জানালেন, “গত বছরের বর্ষায় নদী ছিল প্রায় ২০ মিটার দূরে, এখন সেটা এসে পৌঁছেছে উঠোনে। কয়েকদিন আগেই প্রশাসন কাজ শুরু করেছিল বাঁধ দেওয়ার, কিন্তু পাথরের অভাবে সেই কাজ মাঝপথেই বন্ধ হয়ে গেছে।”
বাসিন্দারা জানিয়েছেন, প্রশাসনের তরফে কিছু পাথর ফেলা শুরু হলেও তা ছিল খুবই সামান্য। বর্ষা পুরোপুরি শুরু হলে যে কী বিপদ ঘটতে পারে, তা ভাবলেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। অনেকেই এখন অস্থায়ী ভাবে মাচায় ঘর বেঁধে নদীর পাড়ে রাত কাটাচ্ছেন। চোখের সামনে ভাঙছে মাটি, ধসে পড়ছে পাড়, আর তারই গা ঘেঁষে ঘর। ছোট ছোট শিশুরা ভয় পাচ্ছে, বয়স্করা রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন নদীর গতিপথ।
জলঢাকা নদীর এই ভয়াবহ রূপ যে কেবলই আবহাওয়া জনিত নয়, তা বলছেন পরিবেশবিদরাও। স্থানীয় পরিবেশকর্মী প্রিয়ঙ্কর দাস জানিয়েছেন, “পাহাড়ে বন ধ্বংস, লাগামছাড়া নির্মাণ, এবং যথেচ্ছ খাল কাটা ও নদীর গতিপথ বদলে দেওয়ার ফলেই নদী এখন নিয়ন্ত্রণহীন। প্রশাসনের উচিত নদী সংস্কার প্রকল্প নিয়ে এগোনো এবং গ্রামবাসীদের দ্রুত পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা।”
জলপাইগুড়ি জেলা প্রশাসনের তরফে এক আধিকারিক জানিয়েছেন, “আমরা ইতিমধ্যে রিপোর্ট পেয়েছি, জরুরি ভিত্তিতে বাঁধ নির্মাণ এবং নদীর ভাঙন রোধে প্রকল্প রূপায়ণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে কিছু কারিগরি সমস্যা এবং উপকরণের ঘাটতির কারণে কাজ স্থগিত রাখা হয়েছে। দ্রুত পুনরায় কাজ শুরু হবে।”
অন্যদিকে স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্যা সীমা রায় বলেন, “আমরা বারবার প্রশাসনকে জানিয়েছি। আমাদের গ্রামবাসীরা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। পাটকিদহ, ডাঙ্গাপাড়া, বারোঘরিয়ার একাংশ এখন নদীর মুখোমুখি। প্রশাসন যেন দ্রুত এই এলাকাকে বিপদসীমার তালিকাভুক্ত করে এবং প্রয়োজনে ত্রাণ শিবির খোলে।”
ভবিষ্যতের দিক থেকে দেখলে এই পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক। নদীর ভাঙন যদি এমনিভাবে চলতেই থাকে, তবে অদূর ভবিষ্যতে সম্পূর্ণ গ্রাম নদীগর্ভে তলিয়ে যেতে পারে। যেসব পরিবাররা কৃষিকাজে নির্ভরশীল, তাদের জমিও নষ্ট হয়ে যাবে। স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র এমনকি রাস্তা পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর সমাধান কেবল অস্থায়ী বাঁধে নয়, বরং প্রয়োজন একটি স্থায়ী ও পরিবেশবান্ধব নদী ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা। পাহাড়ি জলাধার থেকে নেমে আসা জল কীভাবে নিয়ন্ত্রিত হবে, কোথায় বাধ দিতে হবে, কোথায় নদীর গতিপথ খনন করে সামঞ্জস্য রাখা যাবে – এই সমস্ত কিছু নিয়েই চাই একটি সমন্বিত উদ্যোগ।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন একটাই – প্রশাসন কি এবার তৎপর হবে? নাকি প্রতি বছরের মত আবারও সময়ের অপেক্ষা করে জলঢাকার করাল গ্রাসে ভেসে যাবে পাটকিদহ-বারোঘরিয়ার জনজীবন?