Record quantity of Hilsa will be harvested in Digha:দিঘার ফিসারম্যান ঘাটে এখন এক অন্যরকম উত্তেজনার আমেজ। ১৪ জুন শেষ হচ্ছে দীর্ঘ প্রতীক্ষার ব্যান পিরিয়ড, আর তারপরই পূর্ব মেদিনীপুরের উপকূলবর্তী অঞ্চল জুড়ে শুরু হচ্ছে মরসুমী মৎস্য অভিযান। এ বছর সেই অভিযানে সবচেয়ে বড় আশার নাম—ইলিশ। শেষ দু’বছর ইলিশের টানাপোড়েনে ভুগলেও এবছর একপ্রকার রেকর্ড পরিমাণ ইলিশ ধরা পড়বে বলেই জোর আশাবাদী মৎস্যজীবী, মৎস্য ব্যবসায়ী ও দিঘার ট্রলার মালিকরা। “খবর বাংলা”-র প্রতিবেদক হিসেবে আমরা হাজির হই দিঘার নিলাম কেন্দ্র, স্থানীয় মৎস্যজীবী পাড়ায়, আর কথা বলি সরাসরি সাগরে নামার অপেক্ষায় থাকা সেই মানুষগুলোর সঙ্গে, যাদের জীবনটাই জড়িয়ে আছে সমুদ্রের ঢেউ আর সেই রূপালী মাছের সঙ্গে।
দিঘার নাড়ুগোপাল কোলা, পেশায় একজন অভিজ্ঞ মৎস্যজীবী, জানালেন—“গত দু’টো বছর আমাদের কাছে যেন দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যে ইলিশের জন্য আমরা ঝড়-জল মাথায় নিয়ে সমুদ্র পাড়ি দিই, সেই মাছই ধরতে পারিনি। কিন্তু এবছর আমরা খুব আশাবাদী। কারণ ব্যান পিরিয়ডে এবার কড়া নজরদারি ছিল। মাছের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হয়নি, ফলে মনে হচ্ছে এবার সেই অভাব পূরণ হতে চলেছে।”প্রতি বছর জুন মাসে ৬০ দিনব্যাপী মাছ ধরায় নিষেধাজ্ঞা বা ‘ব্যান পিরিয়ড’ জারি থাকে, যাতে সমুদ্রের মাছ বিশেষ করে ইলিশ প্রজননের সময়টুকু সুরক্ষিত থাকে। এবছর সেই নিষেধাজ্ঞার শেষে দিঘা সহ পুরো উপকূল অঞ্চলের প্রায় ২০০০ লঞ্চ, ট্রলার ও যন্ত্রচালিত নৌকা ইলিশ ধরার উদ্দেশ্যে সমুদ্র যাত্রায় নামবে। ট্রলার মালিক অরুণ পাল বললেন—“যে রকম আবহাওয়া, সমুদ্রের জলের গুণমান আর ব্যান পিরিয়ডে জাল না পড়ার কারণে এবছর ভালো ইলিশ ধরা পড়বে বলেই আমরা ভরসা রাখছি। গত বছরের ক্ষতি যদি এবার ঘোচানো যায়, তবে আমাদের মতো ছোট মালিকদের পরিবার আবার একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে।”দিঘার মৎস্যবন্দরে ইতিমধ্যেই প্রস্তুতি তুঙ্গে। এশিয়ার বৃহত্তম সামুদ্রিক মাছ নিলাম কেন্দ্র দিঘা মাছ বাজারে এখনই শুরু হয়েছে নিলামের তালিম ও ট্রলার মেরামতের কাজ। কারখানা থেকে বরফ তৈরির মেশিন শুরু হয়েছে পূর্ণ ক্ষমতায়। স্থানীয় ইলিশ প্রেমী থেকে ব্যবসায়ী, সবাই একরকম উন্মুখ হয়ে রয়েছেন। বাঙালির মনে ইলিশ শুধু মাছ নয়, আবেগ, উৎসব, ঐতিহ্য। যে কোনও খাওয়াদাওয়ার আসরে ইলিশের একটা পদ মানেই জমজমাট আয়োজন। দিঘার স্থানীয় রেস্টুরেন্ট মালিক মনোজ বাবু বলেন, “ইলিশ উঠলে আমাদের ব্যবসাও জমে ওঠে। পর্যটকরাও খুশি হন, খাবারের মেনুতেও নতুন বৈচিত্র্য আসে।”

তবে এই ইলিশের স্বপ্নটা শুধুই রোমাঞ্চ বা আবেগ নয়, এটাও এক বিশাল অর্থনৈতিক ইন্ডাস্ট্রি। পূর্ব মেদিনীপুর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার হাজার হাজার পরিবার এই মাছের ওপর নির্ভর করে। স্থানীয় মৎস্যজীবী সংগঠনের সভাপতি বিভাস জানা বললেন, “ইলিশ ধরা যদি এবার ভালো হয়, তাহলে শুধু ট্রলার মালিকই নয়, ট্রলার চালক, জাল মেরামতির শ্রমিক, বরফ কোম্পানি, পরিবহণ সংস্থা—সবাই উপকৃত হবে। গত বছরের ক্ষয়ক্ষতির কিছুটা হলেও ঘরবাড়ি সামলানো যাবে।”তবে পরিবেশবিদরা কিছুটা সতর্কও করছেন। ইলিশের বংশবিস্তারে ভয়ানক প্রভাব ফেলতে পারে অতিরিক্ত মৎস্য আহরণ, জলদূষণ ও নদীর বাঁধ নির্মাণ। নদীর গতিপথ ও লবণাক্ততা পরিবর্তনের ফলে ইলিশের স্বাভাবিক প্রজনন প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন বিশ্বনাথ হালদার নামে এক সমুদ্র গবেষক। তাঁর মতে, “ইলিশ প্রজননের জন্য নিষিদ্ধ সময়ে জাল ফেলা বন্ধ রাখতে হবে। পাশাপাশি, সুন্দরবনের নদীগুলোর বাঁধ নির্মাণ ও নাব্যতা রক্ষা করা দরকার। না হলে দীর্ঘমেয়াদে ইলিশের ভবিষ্যৎ ঝুঁকিতে পড়বে।”ইতিমধ্যেই রাজ্য মৎস্য দফতর একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে—ফিশিং জোন চিহ্নিতকরণ, জিপিএস ব্যবহার করে ট্রলারের গতিপথ পর্যবেক্ষণ, প্রজনন কালে নিয়মিত নজরদারি—সব মিলিয়ে এবছরের পরিস্থিতি আগের তুলনায় অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত ও সহায়ক। রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী বঙ্কিম হাজরা এক প্রেস বিবৃতিতে জানিয়েছেন—“আমরা এবছর বিশেষ নজর রেখেছি যাতে ব্যান পিরিয়ড মানা হয় এবং ইলিশের প্রজনন স্বাভাবিকভাবে সম্পন্ন হয়। এবছর যে ট্রলাররা সাগরে নামবে, তাদের প্রত্যেকের কাছে ই-ফিশ অ্যাপ ও জিপিএস ট্র্যাকিং থাকবে। এতে মৎস্যজীবীরাও নিরাপদ, আর সরকারের পক্ষ থেকেও পুরো প্রক্রিয়া নজরে রাখা সম্ভব।”সব মিলিয়ে, ১৪ জুনের পর দিঘার সমুদ্র কুলে নামবে হাজার হাজার ট্রলার—সবার চোখে একটাই স্বপ্ন, “এইবার ভালো ইলিশ উঠুক।” শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকেই নয়, একটা আত্মিক ও সাংস্কৃতিক আবেগও জড়িয়ে আছে এই মাছের সঙ্গে। রূপালী ইলিশ এবার কতটা ভরিয়ে দেবে মাছের ঝুড়ি, সেই অপেক্ষায় দিঘা সহ গোটা রাজ্য।