Rainstorms lashed North and South Bengal on the other hand : উল্টোরথের দিন যেমন ধর্মীয় আবেগে ভেসে ওঠে গোটা বাংলা, তেমনই এবার সেই দিনেই প্রকৃতিও যেন তার নিজস্ব রূপে হাজির হয়েছে রাজ্যের উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে। আকাশ যেন ভেঙে পড়ছে, নদী পেরিয়ে রাস্তা, মাঠঘাট সব যেন জলের তলায়। গত কয়েক দিনের ধারাবাহিকভাবে আবহাওয়ার বদলের পর এবার রীতিমতো সতর্কবার্তা জারি করেছে আলিপুর আবহাওয়া দফতর। একদিকে সক্রিয় মৌসুমী অক্ষরেখা, অন্যদিকে পূর্ব-পশ্চিম অক্ষরেখা এবং উপরে ঘূর্ণাবর্ত—এই তিন প্রাকৃতিক উপাদানের মিলিত প্রভাবে গোটা রাজ্যজুড়ে শুরু হয়েছে এক বৃষ্টির তাণ্ডব, যার ফল ভোগ করছে সাধারণ মানুষ থেকে কৃষক, ব্যবসায়ী, পড়ুয়া—সবাই।
উত্তরবঙ্গের পাহাড়ি জেলা দার্জিলিং, কালিম্পং-এর রাস্তা ধসের কারণে একাধিক জায়গায় বন্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয় বাসিন্দা পেমা লামা জানালেন, “দুইদিন ধরে লাগাতার বৃষ্টিতে ঘর থেকে বের হতে পারছি না। বাজারে যেতে পারছি না, খাবারও প্রায় শেষ।” কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ারেও জল জমে পরিস্থিতি জটিল হয়েছে। নদীর জলস্তর বাড়ায় আতঙ্কে রয়েছেন চাষিরা। ধান, পাট, মাছের পুকুর সব ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা। জলপাইগুড়ির কৃষক নির্মল রায় বললেন, “এই সময়টা আমাদের ধানের বীজ রোপণের। কিন্তু মাঠে জল থইথই করছে, চারা নামানো যাচ্ছে না। খুব ক্ষতি হয়ে গেল।”
অন্যদিকে দক্ষিণবঙ্গে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, হুগলি, নদীয়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, দুই ২৪ পরগনা এবং পূর্ব বর্ধমানে ব্যাপক জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। অনেক গ্রাম এখন কার্যত বিচ্ছিন্ন। বাঁকুড়ার ইন্দাস ব্লকে একটি স্কুলে জল ঢুকে পড়েছে, পড়ুয়াদের গৃহে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুরুলিয়ার হুড়া ব্লকে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে এক কৃষকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে। ঝাড়গ্রামের গোপীবল্লভপুরে ধানের খেতে জমে থাকা জলে গোখরো সাপ বেরিয়ে আসায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে।কলকাতা শহরের অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। শনিবার শহরের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল ২৬.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ ৮৯ থেকে ৯৫ শতাংশ। দিনভর আকাশ ছিল মেঘলা। দক্ষিণ কলকাতার তিলজলায় একাধিক গলি জলমগ্ন। রিকশাওয়ালা শ্যামল পাঁজা বললেন, “ভাড়া তো ঠিকই পাচ্ছি, কিন্তু বৃষ্টিতে কাপড় ভিজে যাচ্ছে, গায়ে ঠান্ডা লাগছে। চিকিৎসার খরচ আলাদা।” উত্তর কলকাতার শ্যামবাজার, বাগবাজার এলাকায় জল জমে গেছে রাস্তার ধারে। স্কুলে যাতায়াত কিংবা অফিস যাওয়া চরম দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে সাধারণ মানুষের কাছে।
আবহাওয়াবিদ সুবীর দত্ত জানিয়েছেন, “এই মুহূর্তে একটি ঘূর্ণাবর্ত উড়িষ্যার উপর অবস্থান করছে, যার প্রভাব সরাসরি দক্ষিণবঙ্গে পড়ছে। একইসঙ্গে মৌসুমী অক্ষরেখা সক্রিয় হওয়ায় পশ্চিম থেকে পূর্বে একটি চাপের রেখা সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে উত্তরের পাহাড়ি এলাকা ও দক্ষিণের সমতলভূমি—দুই জায়গায়ই ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকছে।” তিনি আরও বলেন, “সোমবার পর্যন্ত এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকবে। কোথাও কোথাও ৭০ থেকে ১০০ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হতে পারে।”এই বৃষ্টির প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষিজীবী সমাজ। পূর্ব বর্ধমানের কৃষক সমিতির সম্পাদক রমেশ মাঝি জানিয়েছেন, “আমরা আগে থেকেই আবহাওয়ার সতর্কতা শুনেছিলাম, কিন্তু এতটা হবে ভাবিনি। মাঠে জল জমে গেছে, কীটনাশকও ছড়ানো যাচ্ছে না।” তিনি সরকারের কাছে জরুরি ক্ষতিপূরণের আবেদন করেছেন। হাওড়ার ডোমজুড়ে মাছচাষি বিশ্বজিৎ দাস বলেন, “আমার পুকুরে পাঁচ লক্ষ টাকার মাছ ছিল, জল বেড়ে যাওয়ায় প্রায় অর্ধেকই বেরিয়ে গেছে। রাত কাটিয়েছি পাড়ে দাঁড়িয়ে।”
এদিকে দমকা হাওয়া বইছে ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার বেগে। উপকূলবর্তী এলাকায় মৎস্যজীবীদের সমুদ্রে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। দিঘা, মন্দারমণি, শঙ্করপুরে লাল পতাকা ওড়ানো হয়েছে সমুদ্র সৈকতে। পূর্ব মেদিনীপুরের এক মৎস্যজীবী সমিতির নেতা বলেন, “আমরা সরকারি সতর্কতা পেয়েছি। এখন মাছ ধরা বন্ধ। পরিবারের পেট চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।” এই অবস্থায় স্থানীয় প্রশাসন এবং ব্লক আধিকারিকেরা নেমে পড়েছেন নজরদারিতে। কোথাও বাঁধে ফাটল ধরা পড়লে দ্রুত মেরামতির চেষ্টা চলছে।এমন এক পরিস্থিতিতে বারবার উঠছে প্রশ্ন—জলনিকাশি ব্যবস্থা কি যথেষ্ট? পুরসভার আধিকারিক তপন সাহা জানান, “কলকাতার কিছু পুরনো এলাকায় পয়ঃনিষ্কাশনের সমস্যা রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি, কিন্তু যদি অল্প সময়ে অতিরিক্ত জল নামে, তাহলে পুরনো পরিকাঠামো সামলাতে পারে না।”
এই তাণ্ডবের মাঝেও কেউ কেউ রথযাত্রার মেলায় অংশ নিতে বেরিয়েছিলেন। তবে চাকা থামিয়েছে প্রকৃতি। দক্ষিণ ২৪ পরগনার রথতলা এলাকায় জলের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা একটি রথ মেলার ছবি এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল। কেউ লিখেছেন, “প্রকৃতির রথযাত্রা চলছে এবার।”পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার ও প্রশাসনের তরফে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে: অপ্রয়োজনীয় ঘর থেকে না বেরোনো, বিদ্যুৎপৃষ্ট এড়াতে সাবধানে থাকা, এবং সরকারি সতর্কতা মানা। আগামী দিনে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে এই ধরনের হঠাৎ তাণ্ডব আরও বাড়তে পারে বলেই আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাই আবহাওয়ার পূর্বাভাস গুরুত্ব সহকারে দেখা এবং জনজীবনকে তার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সময় এসেছে।