Rain forecast in North Bengal, red alert issued in Teesta: উত্তরবঙ্গ বরাবরই বর্ষার সময় প্রকৃতির রুদ্র রূপের সাক্ষী থাকে। পাহাড়ি ঝরনা, টানা বৃষ্টিপাত আর নদীর হঠাৎ জলস্তর বৃদ্ধি প্রায় প্রতিবছরই মানুষকে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখে ঠেলে দেয়। বিশেষ করে তিস্তা নদী, যার উন্মত্ত স্রোত বহুবার উত্তরবঙ্গের গ্রামাঞ্চলকে বিপর্যস্ত করেছে। এবছরও ব্যতিক্রম নয়। হাওয়া অফিসের পূর্বাভাস অনুযায়ী, সোমবার থেকেই উত্তরবঙ্গের একাধিক জেলায় ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এর সঙ্গে জুড়েছে নদীর জলছাড়ার খবর, যা পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করে তুলেছে।
আবহাওয়া দপ্তরের সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুযায়ী, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, দার্জিলিং ও সিকিম অঞ্চলে টানা বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। এই পূর্বাভাসের পরেই নদী তীরবর্তী এলাকায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে। বিশেষ করে তিস্তা নদীর অবস্থার দিকে বাড়তি নজর রাখা হচ্ছে।জলপাইগুড়ি সেচ দপ্তরের ফ্ল্যাড কন্ট্রোল রুম সূত্রে জানা গেছে, মেখলিগঞ্জ থেকে বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত এবং এনএইচ-৩১ সংলগ্ন জলঢাকা নদীর অসংরক্ষিত এলাকায় লাল সতর্কতা জারি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি বিপদজনক অবস্থার আশঙ্কা দোমহানী এলাকায়। টানা বৃষ্টির কারণে নদীর জলস্তর দ্রুত বাড়তে শুরু করেছে।সোমবার সকালে গজোলডোবা ব্যারেজ থেকে প্রথম দফায় ছাড়া হয় ১৩৫৯ কিউসেক জল। একইসঙ্গে কালিঝোড়া ব্যারেজ থেকেও ছাড়া হয় ১৩৩৬ কিউসেক জল। এরপর সকাল ৯টার সময় গজোলডোবায় আবারও ছাড়া হয় ১৩২৫ কিউসেক এবং কালিঝোড়া থেকে ১৩৫৭ কিউসেক জল। ঘণ্টায় ঘণ্টায় জল ছাড়ার পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে, ফলে নদী তীরবর্তী গ্রামগুলোতে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
সরকারি দপ্তরগুলির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, জল ছাড়ার খবর স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো হয়েছে এবং বাসিন্দাদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। জলপাইগুড়ি সেচ দপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পরিস্থিতির ওপর নিয়মিত নজরদারি চলছে। প্রয়োজনে আরও বেশি জল ছাড়া হতে পারে। ইতিমধ্যেই নদী তীরবর্তী এলাকায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে।আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, জলপাইগুড়িতে আজকের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আর গতকাল সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩১.৩ ডিগ্রি। বাতাসের আর্দ্রতা ৯২% থাকায় বৃষ্টির পরিমাণ বাড়তে পারে। এই অবস্থায় প্রশাসন যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে জানানো হয়েছে।

নদী তীরবর্তী এলাকার বাসিন্দারা ইতিমধ্যেই চিন্তায় দিন কাটাচ্ছেন। তাদের মতে, টানা বৃষ্টি আর জলছাড়া একসঙ্গে হলে আবারও ঘরবাড়ি প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এক গ্রামবাসী জানালেন, “প্রতি বছরই এই সময় তিস্তার জল আমাদের গ্রামে ঢুকে পড়ে। এবারও একই অবস্থা হবে কিনা ভয় পাচ্ছি।”কৃষক মহল বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। কারণ মাঠে ধানের চারা রোপণ করা হয়েছে। অতিরিক্ত বন্যার জলে যদি ফসল ভেসে যায়, তবে ক্ষতির পরিমাণ হবে বিপুল। অনেকে ইতিমধ্যেই গবাদি পশু ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরিয়ে রাখতে শুরু করেছেন।পরিসংখ্যান বলছে, তিস্তা নদীর জলস্তর নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যারেজ থেকে নিয়মিত জলছাড়া হয়। তবে পাহাড়ি এলাকায় অতিরিক্ত বৃষ্টিপাত হলে সেই নিয়ন্ত্রণ ভেঙে পড়ে। জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার এবং কোচবিহারের বিস্তীর্ণ অংশ তিস্তার জলে প্লাবিত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। এবছর যেভাবে ঘণ্টায় ঘণ্টায় জলছাড়া বাড়ানো হচ্ছে, তাতে নদী সংলগ্ন অসংরক্ষিত বাঁধগুলো ভেঙে পড়ার আশঙ্কাও বাড়ছে।

আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পাহাড়ি অঞ্চলে মেঘলা আকাশ ও উচ্চ আর্দ্রতার কারণে আরও বৃষ্টিপাত হতে পারে। এতে শুধু তিস্তা নয়, জলঢাকা নদীসহ অন্যান্য ছোট নদীও ফুলে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে।আগামী কয়েকদিন বৃষ্টির সম্ভাবনা বজায় থাকবে বলেই হাওয়া অফিসের পূর্বাভাস। ফলে পরিস্থিতি আরও জটিল হতে পারে। ইতিমধ্যেই স্থানীয় প্রশাসন ও দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। বিশেষত নদী তীরবর্তী গ্রামগুলিতে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হতে পারে।তবে মূল প্রশ্ন রয়ে যায়, এই ধরনের সংকট পরিস্থিতি মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি সমাধান কী? শুধু ব্যারেজ থেকে জলছাড়া নয়, নদী বাঁধ মজবুতকরণ ও বিকল্প পরিকল্পনার প্রয়োজনীয়তা বিশেষজ্ঞদের মতে এখনই কার্যকর করা দরকার।

উত্তরবঙ্গে আবারও প্রকৃতির রুদ্র রূপের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। টানা বৃষ্টি, ব্যারেজ থেকে বাড়তি জলছাড়া এবং নদী তীরবর্তী এলাকায় লাল সতর্কতা—সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষ আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। প্রশাসন সতর্ক থাকলেও, নদীর উন্মত্ত রূপ যে কোনো সময় ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। এখন দেখার বিষয়, প্রকৃতি ও মানুষ—এই দুইয়ের লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত কার জয় হয়।