Railway line construction project center before Puja : উত্তরবঙ্গবাসীর জন্য এ যেন পুজোর আগে অকালবোধন! দীর্ঘদিনের এক প্রার্থনার যেন জবাব দিল কেন্দ্র সরকার, যখন বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হল আলুয়াবাড়ি রোড থেকে নিউ জলপাইগুড়ি পর্যন্ত তৃতীয় ও চতুর্থ রেললাইন নির্মাণের বহুল প্রতীক্ষিত প্রকল্পকে। ৫৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই রেলপথ তৈরির জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে প্রায় ১,৭৮৬ কোটি টাকা, আর এই ঘোষণার পরেই যেন খুশির হাওয়া বইতে শুরু করেছে সমগ্র উত্তরবঙ্গ ও পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলিতে। সাধারণ মানুষের মুখে একটাই কথা— “এতদিনে বুঝি উন্নয়নের ট্রেন ধরা যাবে!” এই প্রকল্প শুধু একটা রেললাইন নয়, এটা যেন হাজার হাজার মানুষের স্বপ্নকে বাস্তবের মুখ দেখানোর সেতুবন্ধন।
আলুয়াবাড়ি থেকে নিউ জলপাইগুড়ি—এই লাইনে প্রতিদিন চলাচল করে প্রচুর প্যাসেঞ্জার ও মালগাড়ি, যার ফলে এই রুটে দীর্ঘদিন ধরেই ট্রেন লেট ও চাপজনিত সমস্যার অভিযোগ রয়েছে। এই নতুন লাইনের ফলে শুধু পুজোর সময় নয়, সারা বছর ধরেই যাত্রী ও মালপরিবহন দুটোর ক্ষেত্রেই উন্নতি ঘটবে। রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব এই প্রসঙ্গে বলেন, “উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুরক্ষা, পর্যটন এবং বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে এই প্রকল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নতুন লাইনের মাধ্যমে ভুটান, নেপাল, বাংলাদেশের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে।” প্রকল্প বাস্তবায়নের পর উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন শিল্প ও কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি আরও গতিশীল হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। কারণ, এই রেললাইন দিয়ে দ্রুত পণ্য পরিবহন সম্ভব হবে, ফলে কৃষকদের উৎপাদনও পৌঁছাবে সঠিক সময়ে সঠিক বাজারে। শিলিগুড়ির ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক অজয় আগরওয়াল বলেন, “এই রুটটি শুধু আমাদের ব্যবসার জন্য নয়, সামগ্রিকভাবে সমগ্র এলাকার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা বহুদিন ধরে এর দাবি জানিয়ে আসছিলাম। আজ মনে হচ্ছে সরকার আমাদের কথা শুনেছে।” একই সুর শোনা গেল হিন্দুস্থান কেবলের কর্মচারী সংগঠনের নেতা প্রীতম দে-র গলাতেও। তিনি বলেন, “নিউ জলপাইগুড়ি আজ শুধু উত্তরবঙ্গ নয়, গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতের রেল হাব হয়ে উঠেছে। এই প্রকল্প সেই হাবকে আরও শক্তিশালী করবে।” আর যাঁরা প্রতিদিন এই লাইনে যাতায়াত করেন, তাঁদের কাছে এই প্রকল্প যেন মেঘ না চাইতেই জল।
রায়গঞ্জের বাসিন্দা মীনাক্ষী সরকার বলেন, “রোজ অফিস যাওয়ার সময় ট্রেন লেট হয়। এখন যদি নতুন লাইন হয়, তা হলে সময় বাঁচবে, ঝামেলাও কমবে।” এমনকি জলপাইগুড়ির স্কুল শিক্ষিকা রানু ঘোষ বলেন, “রেললাইন থাকলে শুধু যাতায়াত নয়, এলাকার নামডাকও বাড়ে। বাইরে থেকেও লোকজন আসে। এতে এলাকার শিক্ষা, পর্যটন, এমনকি রিয়েল এস্টেটেও প্রভাব পড়ে।” প্রকল্পের কাজ শুরু হবে চলতি অর্থবর্ষের মধ্যেই, রেল সূত্রে এমনই জানানো হয়েছে। চলবে আগামী চার-পাঁচ বছর ধরে। এক্ষেত্রে জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে এবং রাজ্য প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় রেখে কাজ এগোনোর কথা রেলের তরফে বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রকল্প সফল হলে পরে এই রুট দিয়ে সেমি-হাইস্পিড ট্রেন চালানোও সম্ভব হতে পারে। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে দাবি করা হয়েছে, নতুন এই রেললাইন শুধুমাত্র একাধিক ট্রেন চলাচল বাড়ানোর সুযোগই নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা নেবে। কারণ এই রুটটি ভুটান সীমান্ত, শিলিগুড়ি করিডর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত। ফলে সেনা ও জরুরি রসদ পাঠানোর ক্ষেত্রেও গতি বাড়বে। বাণিজ্যিক দিক থেকেও লাভের মুখ দেখবে দেশ।
বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক ট্রেন রুট সম্প্রসারণেও এটি সাহায্য করবে। এই রুট হয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন মালগাড়ি চালানো, ভুটানে নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান তৈরি, নেপালের সঙ্গে ব্যাঙ্কিং যোগাযোগ বৃদ্ধির সম্ভাবনাও উঁকি দিচ্ছে। শিলিগুড়ির বিশিষ্ট সাংবাদিক সন্দীপ সাহা বলেন, “এই প্রকল্প কার্যকর হলে উত্তরবঙ্গের ভৌগলিক গুরুত্ব আরও বাড়বে। এটা শুধু একটা রেললাইন নয়, এর মধ্যে লুকিয়ে আছে সীমান্ত রাজনীতিরও এক দিক।” সব মিলিয়ে এই প্রকল্প উত্তরবঙ্গের সামগ্রিক উন্নয়নের রূপরেখা বদলে দিতে পারে বলেই মত নানা মহলের। একদিকে যাত্রী সুবিধা, অন্যদিকে ব্যবসার প্রসার, সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়ন—সবকিছুর একত্রিত ফসল হতে পারে এই নতুন রেল প্রকল্প। আর সবথেকে বড় কথা, বহুদিন বাদে রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সাধারণ মানুষের স্বার্থে নেওয়া এমন একটি সিদ্ধান্ত দেখে কিছুটা হলেও ভরসা ফিরে পাচ্ছেন উত্তরবঙ্গবাসী। এবারের পুজো তাই নিছকই দুর্গা আরতির আবহ নয়, বরং তার সঙ্গে জড়িয়ে রইল এক নতুন স্বপ্নের যাত্রাপথের সূচনা।