Protests against Israeli attacks in the Gaza Strip : গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলার ছবি যতটা না টিভি পর্দায় ভেসে উঠেছে, তার চেয়েও বেশি রক্তক্ষরণ হয়েছে মানুষের হৃদয়ে—আর তারই জবাব যেন দিল মরক্কোর সাধারণ মানুষ। একেবারে গল্পের মতো লাগলেও ঘটনা একেবারে বাস্তব—রাজধানী রাবাত থেকে শুরু করে মরক্কোর অন্যান্য শহরগুলিতে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে এল, হাতে ছিল ফিলিস্তিনের পতাকা, ব্যানারে ছিল গাজায় নিহত শিশু ও মহিলাদের ছবি, আর ছিল তীব্র স্লোগান—“ফিলিস্তিনের পাশে আছি”, “ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদ চাই”, “গাজা জ্বলছে, বিশ্ব চুপ!”। মরক্কোর এই প্রতিবাদ ছিল না শুধুই এক দিনের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ, বরং এটা যেন ছিল বহু দিনের জমে থাকা হতাশা, দুঃখ আর রাগের মিলিত বিস্ফোরণ। বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন শিক্ষার্থী, শ্রমিক, মানবাধিকার কর্মী, সাধারণ গৃহবধূ থেকে শুরু করে প্রবীণ নাগরিক পর্যন্ত। অনেকেই চোখের জলে বলছিলেন, “আমরা আর সহ্য করতে পারছি না, প্রতিদিন খবরের কাগজে গাজার শিশুদের মৃতদেহ দেখি, আমাদের কিছু একটা করতে হবে।” এই বিক্ষোভের আরও এক বিশেষ দিক হলো, মানুষজন শুধু ইসরায়েল বা হামলার প্রতিবাদ করেননি, তাঁরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও কড়া ভাষায় দোষারোপ করেছেন। এক ব্যানারে লেখা ছিল, “ইসরায়েলের পেছনে ট্রাম্পের ছায়া!”—কারণ অনেকেই মনে করেন আমেরিকার একতরফা সমর্থনই ইসরায়েলকে এতটা উগ্র হতে উৎসাহ দিচ্ছে। অনেকে তো ইসরায়েল ও আমেরিকার পতাকাও জুতোর তলায় পদদলিত করেছেন।
এই বিক্ষোভ মরক্কোর রাজনৈতিক আবহেও বড়সড় ঢেউ তোলে। ২০২০ সালে মরক্কো সরকার যখন ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের চুক্তি করে, তখন অনেকেই মুখে কিছু বলেননি, কিন্তু মনে মনে অনেক ক্ষোভ জমে ছিল—এবার সেই ক্ষোভ যেন রাজপথে ছড়িয়ে পড়ল। এই বিক্ষোভ ছিল সেই চুক্তির পর থেকে অনুষ্ঠিত বৃহত্তম প্রো-ফিলিস্তিনি আন্দোলন, যা প্রমাণ করে দিল যে জনগণের মন থেকে ফিলিস্তিন এখনও মুছে যায়নি। মানবাধিকার সংস্থা এবং ছাত্র সংগঠনগুলো একত্রিত হয়ে এই প্রতিবাদ সংগঠিত করেছিল। এক ছাত্রনেতা জানিয়েছেন, “আমরা শুধু ফিলিস্তিনের জন্য দাঁড়াইনি, দাঁড়িয়েছি আমাদের বিবেককে বাঁচাতে। আজ যদি আমরা চুপ থাকি, আগামীকাল আমাদের ওপরই অত্যাচার হবে।” শুধু মরক্কো নয়, গাজায় ইসরায়েলি বিমান হানার বিরুদ্ধে গোটা মধ্যপ্রাচ্যেই প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। বাগদাদ, তেহরান, কায়রো, আম্মান—সর্বত্রই ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে মানুষ পথে নেমেছে। কিন্তু মরক্কোর এই প্রতিবাদ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণ, এখানকার সরকার ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে, অথচ সাধারণ মানুষ সেই সম্পর্কের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, “এটি শুধু একটি আন্তর্জাতিক বিষয়ে মতপ্রকাশ নয়, এটি সরকারের নীতির বিরুদ্ধে এক ধরণের গণঅসন্তোষের প্রতিফলন।”
গাজার অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে প্রতিদিন মৃত্যু হচ্ছে শত শত মানুষের, হাসপাতালগুলিতে নেই বিদ্যুৎ, ওষুধের ঘাটতি, শিশুরা খেতে পাচ্ছে না, আর সেই ছবি যতটা না মিডিয়ায় দেখানো হচ্ছে, তার চেয়েও বেশি ছড়িয়ে পড়ছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারে মানুষ শেয়ার করছেন আহত শিশুদের ছবি, ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে থাকা মা-বাবার কাঁদো মুখ, আর সেই আবেগই মরক্কোর রাজপথে রূপ নিল বিক্ষোভে। মরক্কোর একজন প্রবীণ বিক্ষোভকারী বলছিলেন, “আমি ৭০ বছরের বৃদ্ধ, কিন্তু আজও মনে আছে কীভাবে ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করা হয়েছিল। আজও সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চলছে।” তার মুখে ছিল একটা হতাশা, কিন্তু চোখে ছিল স্পষ্ট প্রতিবাদ। আন্তর্জাতিক মহলেও মরক্কোর এই প্রতিবাদ আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন এই বিক্ষোভকে স্বাগত জানিয়েছে। Amnesty International এক বিবৃতিতে বলেছে, “এটি দেখিয়ে দিচ্ছে, সরকার কিছু বলুক না বলুক, সাধারণ মানুষ ন্যায়ের পক্ষে আছে।” UN Human Rights Council–এর এক বিশেষ প্রতিনিধি জানিয়েছেন, “গাজার মানবিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করা।”
এই পরিস্থিতিতে আশঙ্কার বিষয় হলো, যদি এই হামলা এবং পাল্টা হামলা চলতেই থাকে, তবে গোটা মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়বে। তেল সরবরাহ, বিশ্ববাজার, এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক—সবই এক অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে যাবে। মরক্কোর এই প্রতিবাদ তাই শুধু এক দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়, এটি বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠার পথে এক জরুরি বার্তা। অনেকেই বলছেন, “গাজার জন্য মরক্কো আজ পথে নেমেছে, আগামীকাল হয়তো বিশ্বও নামবে।” এই প্রতিবাদ আমাদের শেখাচ্ছে, মানবিকতা এখনও মরে যায়নি, এখনও মানুষ অন্য মানুষের জন্য কাঁদে, চিৎকার করে, প্রতিবাদ করে। আজ গাজা, কাল হয়তো আমাদের দেশেরই কোথাও এমন অন্যায় হবে, তখনও কি আমরা চাইবো কেউ না দাঁড়াক? তাই এখনই সময় সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার, এবং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে সমাধানের পথ খোঁজার। কারণ যুদ্ধ কখনো কোনো সমস্যার স্থায়ী সমাধান হতে পারে না।