Protest march of tea workers demanding 20 percent bonus :-দুর্গাপুজোর উৎসব যখন দোরগোড়ায়, সমগ্র রাজ্য যখন মাতোয়ারা মায়ের আগমনী উৎসবে, ঠিক তখনই দার্জিলিংয়ের চা বাগানের শ্রমিকরা বোনাসের দাবিতে প্রতিবাদে নামলেন। তাঁদের প্রধান দাবি, ২০ শতাংশ বোনাস। এর জন্য তাঁরা গত কয়েকদিন ধরে পাহাড়ে মিছিল ও প্রতিবাদ সভা করে আসছেন। শ্রমিকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যতক্ষণ না তাঁদের দাবি মানা হচ্ছে, তাঁরা কর্মবিরতি পালন করে বিক্ষোভ চালিয়ে যাবেন।
চা শ্রমিকদের এই প্রতিবাদ বেশ কিছুদিন ধরেই চলছে। গত সোমবার চা বাগানের শ্রমিক সংগঠনের যৌথ মঞ্চ থেকে ২০ শতাংশ বোনাসের দাবিতে বনধের ডাক দেওয়া হয়েছিল। যদিও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বনধের বিরোধিতা করেন এবং বলেন, বনধকে তিনি কোনোভাবেই সমর্থন করেন না। তিনি ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের মাধ্যমে বোনাসের বিষয়ে একটি সমঝোতায় আসার প্রস্তাব দেন, তবে তিনি এই সমস্যায় হস্তক্ষেপ করবেন না বলেও জানিয়ে দেন।
মঙ্গলবার ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে মালিকপক্ষ, কেন্দ্রীয় সরকার ও শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা বসেন। কিন্তু বৈঠক থেকে আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া যায়নি। মালিকপক্ষ ১৬ শতাংশ বোনাস দেওয়ার প্রস্তাব দেয়, কিন্তু শ্রমিকরা তাঁদের ২০ শতাংশ বোনাসের দাবিতে অনড় থাকে। এই বৈঠকের পর চা শ্রমিকদের মধ্যেও উত্তেজনা আরও বেড়ে যায়, এবং বুধবার তাঁরা ফের মিছিল করে তাঁদের দাবির সমর্থনে প্রতিবাদ জানায়। দার্জিলিংয়ে হাজার হাজার শ্রমিক এই মিছিলে অংশগ্রহণ করেন, এবং তাঁদের প্রতিবাদ সভা পাহাড়ের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়ে।
চা শ্রমিকদের পক্ষ থেকে সমন পাঠক জানিয়েছেন, “আমরা ২০ শতাংশ বোনাসের দাবিতে অনড় রয়েছি। মালিকপক্ষ যদি এই বিষয়ে আমাদের দাবি না মেনে চলে, তাহলে আমরা কর্মবিরতি চালিয়ে যাব এবং প্রতিবাদ চালিয়ে যাব। আমরা জানি, এটি শুধু আমাদের পরিবারের জন্য নয়, এটি আমাদের জীবনের ন্যায্য অধিকার।”
চা বাগানগুলির অর্থনৈতিক অবস্থা এমনিতেই সংকটে রয়েছে। মালিকপক্ষের দাবি, ২০ শতাংশ বোনাস দেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ চা উৎপাদন থেকে যে আয় হয় তা থেকে এত বড়ো বোনাস দেওয়া সম্ভব নয়। তাঁদের বক্তব্য, ১৬ শতাংশ বোনাস দেওয়া মানেই শ্রমিকদের জন্য যথেষ্ট সুযোগ সুবিধা প্রদান করা। তবে শ্রমিকদের বক্তব্য, তাঁদের দিনপ্রতি মজুরি এমনিতেই খুব কম এবং বোনাস তাঁদের পরিবারের উৎসবের সময়ে বাড়তি সহায়তা করতে পারে। ২০ শতাংশ বোনাসের দাবি শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির মধ্যে পড়ে, কারণ বছরের বাকি সময় তাঁদের আয় খুব সীমিত থাকে।
চা শ্রমিকদের এই প্রতিবাদে দার্জিলিংয়ের স্থানীয় সমাজে একপ্রকার উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। পাহাড়ের চা বাগানগুলোতে কর্মবিরতির ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, যা পুরো চা শিল্পের ওপরই প্রভাব ফেলতে পারে। চা বাগানগুলির শ্রমিকরা বেশিরভাগই দরিদ্র, তাঁদের জীবিকা পুরোপুরি চা উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। বোনাস ছাড়া তাঁদের পক্ষে উৎসব পালন করা এবং পরিবারের অন্যান্য প্রয়োজন মেটানো খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। তাই, এই বোনাসের দাবি শ্রমিকদের জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চা শ্রমিকদের নেতাদের মতে, এই আন্দোলন শুধু বোনাসের জন্য নয়, এটি তাঁদের অধিকারের জন্য সংগ্রামের প্রতীক। তাঁদের অভিযোগ, বছরের পর বছর ধরে তাঁরা চা বাগানের মালিকদের দ্বারা শোষিত হচ্ছেন এবং তাঁদের জীবনের মান উন্নয়নে কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। বোনাসের জন্য এই আন্দোলন সেই শোষণের বিরুদ্ধে এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা। শ্রমিকরা মনে করছেন, এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই তাঁরা তাঁদের ন্যায্য অধিকার ফিরে পাবেন।
চা বাগানগুলির মালিকপক্ষও নিজেদের যুক্তি দিয়েছে। তাঁদের মতে, চা শিল্পে মন্দার কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে, আর বিক্রির আয় কমে গেছে। তাই, অতিরিক্ত বোনাস প্রদান তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। চা বাগানের মালিকপক্ষের একজন প্রতিনিধি জানিয়েছেন, “আমরা শ্রমিকদের প্রতি সহানুভূতিশীল। কিন্তু আমাদেরও কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা ১৬ শতাংশ বোনাস দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছি, যা বর্তমান পরিস্থিতিতে খুবই যুক্তিসঙ্গত। তবে শ্রমিকরা যদি আরও বেশি বোনাসের দাবি করে কর্মবিরতি চালিয়ে যায়, তাহলে পুরো শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

এই আন্দোলনের ফলে শুধু চা শিল্প নয়, পাহাড়ের পর্যটন শিল্পেও প্রভাব পড়ছে। দার্জিলিং-এর চা বাগানগুলি শুধুমাত্র চা উৎপাদনের জন্যই নয়, পর্যটনের জন্যও বিখ্যাত। চা শ্রমিকদের প্রতিবাদে চা বাগানগুলোতে পর্যটকদের সংখ্যা কমে গেছে, যা স্থানীয় অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। স্থানীয় ব্যবসায়ী এবং হোটেল মালিকদের বক্তব্য, “চা শ্রমিকদের আন্দোলন চলতে থাকলে আমাদের ব্যবসায় বড় ক্ষতি হবে। পর্যটকরা চা বাগানে আসতে আগ্রহী, কিন্তু বিক্ষোভ এবং কর্মবিরতির কারণে তাঁরা আসতে পারছেন না।”
এই আন্দোলনের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব নিয়ে বিশেষজ্ঞরাও চিন্তিত। শ্রমিকদের দাবি যদি মানা না হয়, তাহলে চা শিল্প আরও গভীর সংকটে পড়তে পারে। অন্যদিকে, যদি মালিকপক্ষ ২০ শতাংশ বোনাস দিতে বাধ্য হয়, তবে উৎপাদন খরচ বেড়ে যেতে পারে, যা চা উৎপাদনের ব্যয় এবং বাজারমূল্যকে প্রভাবিত করবে। ফলে, পুরো শিল্পটি এক জটিল পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে চলেছে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ না করার কথা বললেও, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে রাজ্য সরকারের ভূমিকা নিতে হতে পারে। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির বিষয়ে সরকারেরও দায়িত্ব রয়েছে। তাই, আগামী দিনগুলোতে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে, তা এখনই বলা কঠিন। তবে এই আন্দোলনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করবে চা শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ।
এই মুহূর্তে, চা শ্রমিকদের আন্দোলন এক কঠিন মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। তাঁরা তাঁদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি চালিয়ে যাবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের ন্যায্য দাবি পূরণ না হলে তাঁরা আরও বড় আন্দোলনের পথে হাঁটবেন। তাই, পাহাড়ে চা শ্রমিকদের এই আন্দোলন কেবল বোনাসের লড়াই নয়, এটি তাঁদের অধিকারের লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে। আগামী দিনে এই আন্দোলনের ফলে কী পরিবর্তন আসে, তা দেখার জন্য সবাই অপেক্ষা করছেন।