Monday, July 21, 2025
Google search engine
Homeপশ্চিমবঙ্গশান্তিপুরে অধ্যাপকের গ্রীনহোম মিশন

শান্তিপুরে অধ্যাপকের গ্রীনহোম মিশন

Professor’s Green Home Mission in Shantipur : সারা পৃথিবী জুড়ে এখন জলবায়ু পরিবর্তনের ছায়া। উষ্ণায়নের জেরে বিপর্যস্ত আবহাওয়া, বর্ষার নিয়ম হারিয়ে যাওয়া, শীতের অনিয়মিত উপস্থিতি—সব মিলিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তার ভাঁজ কপালে। বিজ্ঞানীরা বহুবার বলেছেন, প্রকৃতিকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় হলো সবুজায়নের পরিমাণ বাড়ানো। গাছপালা শুধু সৌন্দর্য বা ছায়া দেয় না, আমাদের নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় অক্সিজেনও জোগায়। কিন্তু শহুরে যান্ত্রিক জীবনে মানুষ আজ গাছপালার থেকে দূরে চলে গেছে। ঠিক এই প্রেক্ষিতেই নদীয়ার শান্তিপুর থেকে উঠে এসেছে এক ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত, যেখানে একজন অধ্যাপক নিজের বাড়িকেই বানিয়ে তুলেছেন এক টুকরো সবুজ পৃথিবী।নদীয়ার শান্তিপুর শহরের এক প্রান্তে শান্তভাবে বসবাস করেন রানাঘাট কলেজের অধ্যাপক সোমনাথ কর। তিনি ইংরেজির অধ্যাপক হলেও প্রকৃতির প্রতি তাঁর টান সেই ছোটবেলা থেকেই। গাছ লাগানো তাঁর নেশা, আর সেই নেশা আজ এক বিশাল সবুজ উদ্যোগে পরিণত হয়েছে। তাঁর বাড়ির ছাদ, উঠোন, বারান্দা এমনকি সিঁড়ির ধাপগুলো পর্যন্ত সবুজে মোড়া। শুধু দেশি গাছ নয়, তাঁর সংগ্রহে আছে আমেরিকা, আফ্রিকা সহ একাধিক দেশের বিদেশি গাছেরও উপস্থিতি।

সোমনাথ বাবুর এই সবুজ মিশনে রয়েছে আম, জাম, কাঠাল, নিম, তুলসী, অ্যালোভেরা, ড্রাগন ফ্রুট, আভোকাডো, এমনকি মেক্সিকোর জেড প্ল্যান্টের মতো নানা আন্তর্জাতিক প্রজাতির গাছ। তিনি জানান, “আমি চাই পৃথিবীটা একটু সবুজ হোক। মানুষের জীবন আজ যেভাবে প্রযুক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে, তাতে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের দূরত্ব বেড়ে গেছে। আমি সেই ব্যবধানটা মেটাতে চাই।’’ তাঁর ছেলেবেলা কেটেছে গাছতলায় খেলতে খেলতে, সেই স্মৃতি থেকেই এই টান। তিনি বলেন, “আমার বাড়ির ছাদ এখন যেন একটা মিনি-বোটানিক্যাল গার্ডেন।” এই মুহূর্তে এই উদ্যোগে সরাসরি কোনো সরকারি সহায়তা নেই, তবুও স্থানীয় বন দপ্তরের কয়েকজন আধিকারিক তাঁর কাজ দেখে উৎসাহ জানিয়েছেন। শান্তিপুর পৌরসভার এক কর্মকর্তা বলেন, “এটা নিঃসন্দেহে অনুকরণীয় পদক্ষেপ। যদি প্রতিটি মানুষ নিজের বাড়িতে এমনভাবে গাছ লাগান, তাহলে শহর নিজেই একটি সবুজ নগরীতে পরিণত হতে পারে।’’ রাজ্য পরিবেশ দপ্তর থেকেও অধ্যাপক করের এই প্রচেষ্টাকে প্রশংসা করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।

IMG 20250720 WA0048

সোমনাথ বাবুর এই গ্রীনহোম দেখে অভিভূত। প্রতিবেশী শর্মিষ্ঠা দত্ত বলেন, “প্রতিদিন সকালে ওঁর ছাদ থেকে সবুজ গাছের মধ্যে দিয়ে সূর্যের আলো পড়ে আমাদের উঠোনে, মনটা একেবারে ফ্রেশ হয়ে যায়।” স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক সঞ্জীব দে জানান, “আমরা ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে মাঝে মাঝে ওঁর বাড়িতে ঘুরতে যাই। বাচ্চাদের প্রকৃতির সঙ্গে পরিচিত করানোর এর থেকে ভালো উপায় আর কী হতে পারে!”একটি পরিবারের একার উদ্যোগ কিভাবে সমাজে প্রভাব ফেলতে পারে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ সোমনাথ করের এই সবুজ বাড়ি। আজ যখন শহর জুড়ে কংক্রিটের জঙ্গল, তখন তিনি নিজে হাতে গড়ে তুলেছেন একটি প্রাণবন্ত পরিবেশ। এই ধরনের সবুজায়ন কেবল সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে না, বরং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, বাতাস পরিষ্কার রাখা এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতেও সাহায্য করে। তাঁর মতে, শুধু গাছ লাগানোই নয়, নিয়মিত তাদের যত্ন নেওয়াটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই প্রতিদিন সকালে ও রাতে তিনি নিজেই গাছগুলোর জল দেওয়া, ছাঁটাই করা, পোকামাকড় থেকে রক্ষা করা এই সমস্ত কাজ করেন।

IMG 20250720 WA0049

অধ্যাপক করের পরিকল্পনা এখানেই থেমে নেই। তিনি আগামী দিনে নিজের এই বাড়িকে পরিবেশ শিক্ষা কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। যেখানে ছাত্রছাত্রীরা এসে গাছ চেনা শিখবে, কীভাবে গাছ লাগাতে হয় ও তার যত্ন নিতে হয়, সে শিক্ষা পাবে। তিনি চান শহরের প্রতিটি মানুষ অন্তত বছরে একটি করে গাছ লাগাক ও তার যত্ন নিক। তাঁর লক্ষ্য, “একজন লাগালে এক গাছ, দশজন লাগালে বন।”একটি ছোট শহরের এক সাধারণ মানুষ, যাঁর পরিচয় একজন অধ্যাপক হিসেবে হলেও তাঁর স্বপ্ন ও কাজ আজ বিশ্বব্যাপী ভাবনা জাগাচ্ছে। সোমনাথ কর প্রমাণ করে দিলেন, বড় কিছু করতে গেলে বড় মঞ্চের দরকার পড়ে না, দরকার পড়ে বড় মনের। পরিবেশ রক্ষা নিয়ে যখন বিশ্বের তাবড় নেতারা শুধু বক্তৃতায় ব্যস্ত, তখন একজন সাধারণ নাগরিক হাতে তুলে নিয়েছেন প্রকৃতির ঝান্ডা। গাছকে ভালোবাসার এ এক অনন্য বার্তা, যা এই কংক্রিটের শহরে যেন একটু শান্তির ছায়া এনে দেয়।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments