Sunday, July 13, 2025
Google search engine
HomeUncategorisedবেহাল শিশু ঝুমরা স্বাস্থ্যকেন্দ্র

বেহাল শিশু ঝুমরা স্বাস্থ্যকেন্দ্র

Poor Shishu Jhumra Health Center : শিশুঝুমরা — নামটা শুনলেই মনে পড়ে যায় আলিপুরদুয়ারের প্রত্যন্ত জঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট একটি জনপদের কথা। প্রকৃতির সৌন্দর্যে মোড়া এই এলাকায় বাস করেন প্রায় চল্লিশ হাজারেরও বেশি সাধারণ মানুষ। আর তাঁদের স্বাস্থ্য পরিষেবার একমাত্র ভরসা হল শিশুঝুমরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। কিন্তু আজ এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি নিজেই ‘চিকিৎসাধীন’ অবস্থা পার করছে, পড়ে রয়েছে অবহেলায়, কার্যত পরিত্যক্ত ভবনের মতো। যে ভবন এক সময় রোগীদের আশার আলো ছিল, তা আজ মৃত্যুর ছায়া হয়ে দাঁড়িয়েছে এলাকার মানুষের কাছে।স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির বর্তমান পরিস্থিতি এক কথায় ভয়াবহ। হাসপাতালের সামনে নেই কোনো বাউন্ডারি ওয়াল, নেই প্রবেশদ্বার, চারপাশে ঘন জঙ্গল। সন্ধ্যার পরই অন্ধকারে ডুবে যায় পুরো এলাকা। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে বন্যপ্রাণীদের আনাগোনা শুরু হয় — কখনও সাপ, কখনও বুনো শুকর, আবার কখনও জংলি কুকুর। হাসপাতালের পেছনের দিকে জঙ্গল এতটাই ঘন যে রোগী বা স্বাস্থ্যকর্মী—কেউই নিরাপদ নন। কোনো রকম নিরাপত্তা নেই, সিসিটিভি তো দূরের কথা, একজন নিরাপত্তারক্ষী পর্যন্ত নেই গোটা প্রাঙ্গণে।এই ভয়ংকর পরিবেশে যারা প্রতিদিন কাজ করছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন মাত্র একজন ডাক্তার ও দুইজন নার্স। এত বড় এলাকায় মাত্র তিনজন স্বাস্থ্যকর্মী দিয়ে কীভাবে চিকিৎসা চালানো সম্ভব, তা ভেবে পাচ্ছেন না কেউ। একসময় এই কেন্দ্রে ছিল স্থায়ী শয্যার ব্যবস্থা, ছিল অপারেশন থিয়েটার, খোলা ছিল ডেলিভারি ইউনিট। কিন্তু এখন? শুধু বাইরের ওষুধ দিয়ে রোগীকে ফিরে যেতে বলা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেন না কর্তব্যরত ডাক্তার। একাধিক পরিত্যক্ত ঘর, ভাঙাচোরা ছাদ, নোংরা শৌচাগার আর বন্ধ হয়ে থাকা ওটিতে জমে থাকা ধুলো এখন যেন এ ভবনের একমাত্র পরিচয়।স্থানীয় বাসিন্দা মানিক রায় বললেন, “কোনও একজন বাড়ির লোক অসুস্থ হলে আগে ছুটে আসতাম এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। এখন আর কেউ আসে না। শুধু ডাক্তার নেই বললে ভুল হবে, জায়গাটা এমনভাবে পড়ে আছে, যেন কেউ ভুলে গিয়েছে এখানকার অস্তিত্ব।”

একই কথা বলছেন কলেজ পড়ুয়া সুলেখা তামাং, “আমার দাদুর হাই ব্লাড প্রেসারের সমস্যা আছে। মাঝরাতে একদিন খুব অসুস্থ হয়ে পড়ে গেলেন। এখান থেকে বীরপাড়া হাসপাতালে নিয়ে যেতে দেড় ঘণ্টা লেগেছিল। যদি শিশুঝুমরা হাসপাতালে সুযোগসুবিধে থাকত, তবে হয়তো দাদুকে এতটা কষ্ট পেতে হতো না।”এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রাক্তন কর্মী এক নার্স বলেন, “আমি এখানে তিন বছর কাজ করেছি। শুরুতে খুব ভালো পরিষেবা ছিল। পরে একে একে সব পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায়। আলো থাকত না, জলের সমস্যা হত, ছাদ চুঁইয়ে জল পড়ত। ভয় পেয়ে অনেকেই চাকরি ছেড়ে চলে যান।”এই চিত্র দেখে প্রশ্ন উঠছে — কেন এই গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যকেন্দ্র আজ এমন বেহাল দশায় পরিণত হল? এই অবহেলার পেছনে কি প্রশাসনিক উদাসীনতা, নাকি রাজনৈতিক অনীহা?একাধিক গ্রাম পঞ্চায়েতের অধীনে থাকা এই এলাকাটি মূলত চা বাগানের শ্রমিক অধ্যুষিত। এখানকার মানুষরা বেশিরভাগই দরিদ্র ও দিনমজুর শ্রেণির। তাঁদের পক্ষে বীরপাড়া বা আলিপুরদুয়ার শহরে গিয়ে চিকিৎসা করানো খুব একটা সহজ নয়। ভাড়া, সময়, পথের কষ্ট — সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা এক বড় প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড়িয়ে।এলাকার প্রবীণ সমাজকর্মী বিনোদ কুজুর বলছেন, “স্বাস্থ্য একটা মৌলিক অধিকার। অথচ শিশুঝুমরার মতো জনবহুল এলাকার স্বাস্থ্যকেন্দ্র এতদিন ধরে বেহাল অবস্থায় পড়ে রয়েছে — এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। আমরা বহুবার ব্লক স্বাস্থ্য দপ্তর, পঞ্চায়েত ও জেলা প্রশাসনকে লিখিতভাবে জানিয়েছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।”

Screenshot 18

তিনি আরও জানান, অন্তত জঙ্গল পরিষ্কার, আলো ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঠিক করা, ডাক্তার ও নার্স নিয়োগ এবং ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করলেই শিশুঝুমরা স্বাস্থ্যকেন্দ্র আবার তার পুরনো চেহারায় ফিরতে পারে। মানুষ অন্তত প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য এখানেই ভরসা করতে পারবেন।জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিক (CMOH) ডাঃ পার্থসারথি দাস বলেন, “আমাদের কাছে বিষয়টি ইতিমধ্যেই এসেছে। খুব শীঘ্রই জঙ্গল পরিষ্কার, আলোর ব্যবস্থা, এবং সীমিত পরিষেবায় পুনরায় ডাক্তার ও নার্সের নিয়োগ করা হবে। তবে নতুন করে পুরোপুরি মেরামতির জন্য বরাদ্দের প্রয়োজন, সেই বিষয়ে স্বাস্থ্য দপ্তরে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।”তবে এই ‘প্রস্তাব’ আর ‘পর্যালোচনা’ কথাগুলি গত ৫ বছর ধরেই শোনা যাচ্ছে। বাস্তবে কাজের কাজ খুব একটা কিছু হয়নি বলেই অভিযোগ বাসিন্দাদের। এখন তাঁরা আর আশ্বাস চান না, তাঁরা চান ফল।সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল, পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য দপ্তর ২০২৪ সালে যে ‘গ্রামীণ স্বাস্থ্য পুনর্গঠন’ প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছিল, সেই তালিকায় শিশুঝুমরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নামই নেই। এটা কি শুধুই প্রশাসনিক ভুল, নাকি অঞ্চলটির প্রতি উপেক্ষা, সেই প্রশ্ন তুলছেন স্থানীয় নেতৃত্বও।এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের গুরুত্ব আরও বোঝা যায় যখন জানা যায়, এখানে আশেপাশের প্রায় ১২টি চা বাগান এলাকার মানুষ নির্ভর করেন প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য। কিন্তু যদি হাসপাতালেই না থাকে চিকিৎসক, না থাকে ওষুধ, না থাকে নিরাপত্তা — তাহলে সেই ভবন আর কিসের?এলাকাবাসীর তরফ থেকে এখন জোর দাবি উঠছে — “অবিলম্বে শিশুঝুমরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র পুনরায় চালু করা হোক। পূর্ণকালীন চিকিৎসক, পর্যাপ্ত নার্স, আলো, বাউন্ডারি ওয়াল, নিরাপত্তা ও জঙ্গল পরিষ্কারের ব্যবস্থা নেওয়া হোক।” না হলে ভবিষ্যতে বড় ধরনের স্বাস্থ্য সংকট দেখা দিতে পারে, যার মূল্য চোকাতে হবে সাধারণ মানুষকেই।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments