Phones have to be stored outside Trinamool meetings : হাবরার এক নম্বর ব্লকের কন্যাশ্রী হলে বুধবার দুপুর থেকে শুরু হওয়া তৃণমূল কংগ্রেসের একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং নিয়ে এখন চরম বিতর্ক। মূলত দলের ভোটার তালিকা শুদ্ধিকরণ ও ভুয়ো ভোটার চিহ্নিতকরণ নিয়ে এদিন এই বৈঠক ডেকেছিলেন হাবরার বিধায়ক তথা দাপুটে তৃণমূল নেতা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক। কিন্তু মিটিং শুরু হতেই দেখা গেল এক অদ্ভুত দৃশ্য—প্রত্যেক কর্মীকে ঢোকার আগে তাঁদের মোবাইল ফোন বাইরে রেখে তবেই মিটিংয়ে ঢুকতে হচ্ছে। আর এই ছবি ধরা পড়েছে ক্যামেরার লেন্সে, যেখানে নিজেই বিধায়ক জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে নিজের ফোন জমা রাখতে দেখা গেছে। মুহূর্তের মধ্যে সেই ছবি ছড়িয়ে পড়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়, এবং তাতেই শুরু হয়েছে তীব্র রাজনৈতিক চাপানউতোর।
জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক অবশ্য এই বিষয়ে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, “দলের গোপনীয়তা রক্ষা করা আমাদের কর্তব্য। দলের মধ্যে যেটা বলা দরকার সেটা প্রেসকে জানানো হবে, আর যা গোপন রাখতে হবে তা বাইরে বলা যাবে না। তাই এই সিদ্ধান্ত।” তবে তাঁর এই মন্তব্য ঘিরে বিজেপি নেতারা কটাক্ষ করতে ছাড়ছেন না। বিজেপির হাবরা মণ্ডলের সভাপতি অমিতেশ বাগচী বলেন, “তৃণমূলের মিটিং মানেই গোপন চক্রান্ত। ফোন নিয়ে গেলে যে সত্যি বেরিয়ে আসতে পারে, তাই ওরা ফোন জমা রাখছে। গোপনীয়তার আড়ালে আবারও কোনো ষড়যন্ত্র চলছে না তো?” পাশাপাশি বিজেপি নেতাদের আরও অভিযোগ, তৃণমূলের এই ফোন জমা রাখার নির্দেশ আসলে ভোট ব্যাংক নিয়ে গোপন বৈঠকেরই অংশ, যাতে ভুয়ো ভোটার ম্যানেজ করা যায়।
তবে মিটিংয়ে উপস্থিত থাকা এক মহিলা তৃণমূল কর্মী প্রমিলা রায় বলেন, “আমি এতদিন মিটিং করেছি, কিন্তু এই প্রথম ফোন বাইরে রেখে ঢুকলাম। প্রথমে অবাক লাগলেও পরে বুঝলাম, কিছু বিষয় হয়তো খুব গোপন রাখতে হয়। তবে আমাদের মিটিংয়ে যা আলোচনা হয়েছে, তা দলের মঙ্গল ছাড়া কিছু নয়।” অন্যদিকে হাবরা ব্লকের এক তৃণমূল নেতা সঞ্জয় রায় জানান, “মোবাইল ফোনে রেকর্ডিংয়ের ভয় থেকেই এই ব্যবস্থা। অনেক সময় মিটিংয়ের কথা বাইরের লোকদের কাছে চলে যায়, যা দলের ক্ষতি করে। তাই এই সিদ্ধান্ত।”
এই ফোন জমা রাখার নিয়মকে কেন্দ্র করে সাধারণ মানুষের মধ্যেও মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকেই বলছেন, এখনকার দিনে যেখানে ফোন আমাদের জীবনের অংশ, সেখানে এভাবে ফোন রেখে মিটিং করাটা কিছুটা অস্বস্তিকর। হাবরার এক স্থানীয় ব্যবসায়ী দেবাশিস দাস বলেন, “রাজনীতির মিটিং মানে খোলাখুলি আলোচনা হওয়া উচিত। গোপনীয়তার নামে ফোন রাখা মানে তো সন্দেহের উদ্রেক করে। জনগণ কি তাহলে বিশ্বাস হারাবে না?”
অন্যদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, “রাজনীতির জগতে গোপনীয়তা নতুন কিছু নয়। তবে মিটিংয়ে ফোন না রাখার নিয়ম মানে দলের মধ্যে কোনও স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত হতে চলেছে। হয়তো ভোটের আগে প্রার্থী বাছাই, ভুয়ো ভোটার ম্যানেজমেন্ট বা কোনও গুরুত্বপূর্ণ কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়েছে, যা দলের বাইরে গেলে সমস্যার হতে পারে।”
এই ঘটনার পেছনে আরও একটি সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে—মোবাইল ফোন থেকে রেকর্ড হওয়া অডিও বা ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হওয়ার ভয়। গত কয়েক বছরে দেখা গেছে, রাজনৈতিক মিটিংয়ের গোপন ভিডিও ফাঁস হয়ে নানা বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। তাই হয়তো এই ব্যবস্থা। তবে তৃণমূলের একাংশের মধ্যেও চাপা ক্ষোভ রয়েছে, তাঁরা মনে করছেন, “ফোন রাখা মানে নেতা-কর্মীদের ওপর অবিশ্বাস করা হচ্ছে।” হাবরার তৃণমূলের এক কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “মোবাইল রেখে ঢুকতে হবে, এটা শুনে অনেকেই মিটিংয়ে আসতে ইতস্তত করছে।”
এই নিয়ম নিয়ে রাজনৈতিক মহলে জল্পনা তুঙ্গে। অনেকে বলছেন, ভোটের আগে ভুয়ো ভোটার বা ভোটের কৌশল নিয়ে এমন কিছু আলোচনা হয়েছে, যা প্রকাশ পেলে প্রশাসনিক বা রাজনৈতিকভাবে ঝামেলায় ফেলতে পারে তৃণমূলকে। আবার কেউ বলছেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন দলের মধ্যে ভাঙন বা বিদ্রোহের আশঙ্কা থাকায় এই বাড়তি সতর্কতা। অর্থাৎ, দলের ভেতরের খবর যেন বাইরে না যায়, সেটাই প্রধান লক্ষ্য।
বড় প্রশ্ন হচ্ছে—এই ফোন জমা রাখার নিয়ম কি একদিনের? নাকি এটা ভবিষ্যতে তৃণমূলের প্রতিটি মিটিংয়ে প্রথা হয়ে দাঁড়াবে? যদি এটা প্রথা হয়, তাহলে দলের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই। সাধারণ মানুষ ভাবতে পারে, “দলের ভেতর কী এমন হচ্ছে, যা এত গোপন রাখতে হচ্ছে?” আর এই সন্দেহের বাতাবরণ যদি তৈরি হয়, তাহলে ভোটের সময় মানুষের আস্থা কমতে পারে, যা তৃণমূলের জন্য বিপদের বার্তা।
সবশেষে বলা যায়, হাবরার মিটিংয়ে ফোন রাখা নিয়মের মধ্যে দিয়ে তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ কৌশল, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক তৎপরতার এক নতুন অধ্যায় শুরু হল। এটা শুধু হাবরার ঘটনা নয়, এর প্রভাব রাজ্যের অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়তে পারে। আর এই নিয়ম আগামী দিনে বাংলার রাজনৈতিক মঞ্চে এক নতুন বিতর্কের রসদ হয়ে উঠতে পারে।