Thursday, May 22, 2025
Google search engine
Homeঅন্যান্য জাপান নয়,মিয়াজাকি এখন দুর্গাপুরেই !

 জাপান নয়,মিয়াজাকি এখন দুর্গাপুরেই !

Not Japan Miyazaki is now in Durgapur

Not Japan Miyazaki is now in Durgapur:শিল্পাঞ্চলের কাঁকুরে, রুক্ষ মাটি, যেখানে সাধারণত কারখানার ধোঁয়া, সিমেন্টের গুঁড়ো আর ইস্পাতের শব্দই নিত্যসঙ্গী, সেই দুর্গাপুরেই এখন জাপানের সবচেয়ে দামী ফল মিয়াজাকি আমের সুবাসে মন মাতছে চাষিদের। কে ভাবতে পারতো! যেখানে বর্ষাকালে জল দাঁড়ায় না, গরমে জমি চৌচির হয়ে ওঠে, সেই জমিতে এখন পরীক্ষামূলকভাবে জন্ম নিচ্ছে জাপানের রক্তিম রত্ন — মিয়াজাকি ম্যাঙ্গো। রাজ্যের প্রাণীসম্পদ বিকাশ দপ্তরের প্রাক্তন আধিকারিক ও কৃষি গবেষক অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন দুর্গাপুর পূর্ব বিধানসভার মলানদিঘি পঞ্চায়েতের লোহাগুড়ি গ্রামের এক খন্ড রুক্ষ জমিতে। তাঁর সঙ্গী হয়েছেন বন্ধু শান্তনু মুখোপাধ্যায়, যাঁর ১৭ বিঘা জমিতে এখন শুধুই নয় মিয়াজাকি, চাষ হচ্ছে ব্ল্যাক ম্যাঙ্গো (ফ্লোরিডা), হোয়াইট হিমালয়ান মালবেরি, লাল ডোকা কলা ও বহু রঙের নারকেল।

২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক হর্টিকালচার ফেস্টিভালে ১ কেজি মিয়াজাকি আমের দাম উঠেছিল ₹২,৭৫,০০০! এমন এক ফল চাষের সিদ্ধান্ত যখন অনিরুদ্ধ নিলেন, অনেকেই বলেছিলেন “এ পাগলামো ছাড়া কিছু না!” কিন্তু আজ সেই ‘পাগলামি’ই রাজ্যের চাষবাসের ভবিষ্যতের রাস্তা দেখাচ্ছে। অনিরুদ্ধ নিজে কল্যাণী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী, বহু বছর গবেষণা করেছেন ফল ও উদ্ভিদের উপর, আর সেই অভিজ্ঞতাকেই কাজে লাগিয়ে ২০২৩ সালে প্রথমবার পরীক্ষামূলকভাবে লাগালেন জাপানি আম। প্রথম বছরের ফলন সীমিত হলেও, রঙ, স্বাদ ও পুষ্টিগুণে চমকে দিয়েছিল সবাইকে। এ বছর ফলনের পরিমাণ ও গুণগত মান আরও উন্নত হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।

9618c7 bb48b0b137ac40799d8fbc5821cace5d~mv2

এই আম শুধু বাহ্যিক চেহারাতেই আকর্ষণীয় নয়, এতে রয়েছে উচ্চমাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, বিটা ক্যারোটিন ও অন্যান্য পুষ্টিগুণ যা একে করে তোলে সুপারফ্রুট। ইতিমধ্যেই একটি আইসক্রিম সংস্থা হোয়াইট হিমালয়ান মালবেরি কিনতে চায়, কিন্তু অনিরুদ্ধ জানিয়েছেন, “বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু না হওয়ায় এখনো বড় মাপের ডেলিভারি সম্ভব নয়।” তবে রাজ্য সরকারের তরফে ইতিমধ্যেই মিলেছে যথেষ্ট উৎসাহ ও স্বীকৃতি। রাজ্যের কৃষি মন্ত্রী ও দুর্গাপুরের তৃণমূল বিধায়ক প্রদীপ মজুমদার নিজে অনিরুদ্ধের চাষখেত পরিদর্শনে এসে আমের স্বাদ নিয়েছেন, এমনকি সেই আম পৌঁছে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের টেবিলেও। মুখ্যমন্ত্রীর এই উদ্যোগে অনিরুদ্ধের বক্তব্য, “উনি আমার কাজের প্রশংসা করেছেন শুনেছি। এটা আমার চাষির জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার।

” দুর্গাপুরের মতো শিল্পাঞ্চলে এমন উদ্যোগ যে কেবলমাত্র নতুন সম্ভাবনার দিশা দেখাচ্ছে তাই নয়, এটি স্থানীয় অর্থনীতির জন্যেও এক যুগান্তকারী পরিবর্তনের সূচনা। অনিরুদ্ধ বলছেন, “এই অঞ্চলের বহু মানুষ আছেন, যারা কৃষিকাজ জানেন কিন্তু জমির অভাবে কিংবা রুক্ষ মাটির কারণে চাষ থেকে মুখ ফিরিয়েছেন। আমি চাই তারা ফিরে আসুন। রুক্ষ জমিও যদি ফল ফোটাতে পারে, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দিকেই ঘোরে।” এ প্রসঙ্গে স্থানীয় কৃষি আধিকারিক দীপঙ্কর ঘোষ জানিয়েছেন, “আমরা এই পরীক্ষামূলক উদ্যোগে যথাসম্ভব সহায়তা করছি।

ভবিষ্যতে রাজ্য সরকার এ জাতীয় হাই ভ্যালু ফসল চাষে আরও উদ্যোগ নিতে পারে।” শুধু তাই নয়, এই উদ্যোগে স্থানীয় যুবকদেরও প্রশিক্ষণ দিয়ে কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা চলছে। বর্তমানে রাজ্যের অন্য জেলাগুলো থেকেও অনেকে দুর্গাপুরের এই খেত পরিদর্শনে আসছেন, জানছেন কীভাবে অনাবাদি জমিকে রূপান্তর করা যায় স্বর্ণক্ষেত্রে। এমনকি কৃষি প্রযুক্তি কলেজের পড়ুয়ারা এখন অনিরুদ্ধের খামারে বাস্তব প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। লোহাগুড়ি গ্রামে এখন শুধুই রুক্ষ মাটি নয়, সেখানে ‘আশার চারা’ও জন্ম নিচ্ছে। একসময়ের পরিত্যক্ত জমি আজ পরিণত হয়েছে এক রঙিন কৃষি গবেষণাগারে।

images?q=tbn:ANd9GcRv18XVfNCgcisok4 qngl4DshWUPwC7Nyk4g&s

হোয়াইট মালবেরির গাছে ফুটেছে সাদা সাদা ফল, যার মিষ্টি স্বাদ আর পুষ্টিগুণে মন ভরছে সকলের। ব্ল্যাক ম্যাঙ্গো গাছও ধীরে ধীরে ফল দিতে শুরু করেছে, যা সামনের বছর থেকে বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আনার পরিকল্পনা আছে। অনিরুদ্ধের স্বপ্ন, “আমি চাই দুর্গাপুরকে চিনুক সবাই ‘স্টিল সিটি’ হিসাবে নয়, ‘ফ্রুট সিটি’ হিসেবেও।” তাঁর মুখে একটাই কথা, “শুধু উৎসাহ আর কিছুটা গবেষণার ইচ্ছা থাকলেই, অসম্ভব বলে কিছুই থাকে না।” এখন প্রশ্ন, এই প্রকল্প কি শুধু অনিরুদ্ধের খামারেই সীমাবদ্ধ থাকবে? না কি এর প্রসার ঘটবে রাজ্যজুড়ে? রাজ্য কৃষি দপ্তরের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, “আমরা এই প্রকল্পকে মডেল হিসেবে দেখছি। যদি এর সাফল্য বজায় থাকে, আগামীতে পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া – এমন জায়গায়ও মিয়াজাকি কিংবা মালবেরির মতো ফলের চাষ শুরু হতে পারে।” বস্তুত, কৃষি বিপ্লব মানেই যে শুধু ধান-আলু নয়, বরং হাইভ্যালু ফল ও বিশেষ জাতের উদ্ভিদই যে ভবিষ্যৎ কৃষির দিশা দেখাবে — সেই বার্তাই উঠে এসেছে দুর্গাপুরের এই উদ্যোগ থেকে। শিল্পাঞ্চলের বুকে জন্ম নেওয়া এই সবুজ বিপ্লব আজ সকলের কাছে এক অনুপ্রেরণা। আর অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী যেন হয়ে উঠেছেন নতুন যুগের ‘সবুজ সৈনিক’ — যিনি প্রমাণ করে দিলেন, মাটি যদি মন চায়, তবে স্বপ্ন ফোটে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments