New York City hit by heavy rain, roads flooded : নিউ ইয়র্ক শহরের বুকে যেন হঠাৎ করেই নেমে এসেছে এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রবল বৃষ্টিতে কার্যত অচল হয়ে পড়েছে গোটা শহর, জলমগ্ন রাস্তা-ঘাট, বন্ধ হয়ে গিয়েছে ট্র্যাফিক, বিপর্যস্ত হয়েছে জনজীবন। যাঁরা নিউ ইয়র্ককে ‘চিরচঞ্চল শহর’ বলে জানতেন, তাঁদের চোখ আজ বিস্ময়ে বিস্ফারিত। সোমবার সকাল থেকে শুরু হওয়া ভারী বর্ষণে একদিকে যেমন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে শহরের জীবনচক্র, তেমনই উদ্বেগে রয়েছে প্রশাসন, সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ী মহল। শহরের ম্যানহাটন, ব্রঙ্কস, ব্রুকলিন, কুইন্স এবং স্টেটেন দ্বীপ — প্রতিটি জেলাতেই দেখা গিয়েছে বন্যার মতো চিত্র। রাস্তায় হাঁটু জল, কোথাও কোথাও কোমর অবধি। বাস, প্রাইভেট গাড়ি তো দূরের কথা, অ্যাম্বুলেন্সও আটকে পড়েছে জলবন্দি রাস্তায়। মেট্রো স্টেশন, পেট্রল পাম্প, সুপারমার্কেট পর্যন্ত জলমগ্ন — কার্যত এক বিপর্যয়ের চেহারা নিয়েছে নিউ ইয়র্ক।”গতকাল সন্ধ্যায় কাজ থেকে ফিরতে ৫ ঘণ্টা লেগে গিয়েছিল,” জানিয়েছেন ব্রুকলিনের বাসিন্দা ও আইটি কর্মী রোজারিও মিগুয়েল। তিনি আরও বলেন, “ট্রেন বন্ধ, রাস্তা বন্ধ, এক সময় মনে হচ্ছিল ঘরে ফিরতে পারব না।” নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র এরিক অ্যাডামস সংবাদমাধ্যমকে জানান, “এটি শুধুমাত্র বৃষ্টি নয়, এটি একটি ‘ক্রাইসিস’। আমাদের শহর কখনও এমন পরিস্থিতির সাক্ষী হয়নি। পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা ফায়ার ডিপার্টমেন্ট, পুলিশ, ইমারজেন্সি সার্ভিস এবং ভলান্টিয়ারদের একসঙ্গে নামিয়েছি।”
অন্যদিকে নিউ জার্সিতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। সেখানে ইতিমধ্যেই জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা। নিউ জার্সির গভর্নর ফিল মারফি ঘোষণা করেছেন, “বিপর্যয় মোকাবিলার সমস্ত সংস্থা প্রস্তুত। তবে সাধারণ মানুষকে ঘরে থাকার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।” সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, এই বৃষ্টির প্রভাবে ইতিমধ্যেই বাতিল হয়েছে নিউ ইয়র্ক এবং নিউ জার্সির প্রায় ২০০টিরও বেশি ফ্লাইট। জনএফ কেনেডি (JFK), লা গার্ডিয়া (LGA), এবং নিউয়ার্ক লিবার্টি (EWR) বিমানবন্দরে যাত্রীদের একাধিক সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে।জাতীয় আবহাওয়া পরিষেবা (NWS) জানিয়েছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টা আরও ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে। বিশেষত স্টেটেন আইল্যান্ড এবং ম্যানহাটন অঞ্চলে অতিরিক্ত সতর্কতা জারি করা হয়েছে। শুধু নিউ ইয়র্ক বা নিউ জার্সিই নয়, বরং পুরো উত্তর-পূর্ব এবং মধ্য-আটলান্টিক অঞ্চলে এই বৃষ্টির প্রভাব পড়ছে। আবহাওয়াবিদ জন বার্লিংমে বলেছেন, “এই ধরনের প্রবল বর্ষণ সাধারণত ঘূর্ণিঝড়ের সময় দেখা যায়। তবে এবার এর উৎস মূলত হাই-ময়শ্চার লো প্রেসার সিস্টেম, যা আবহাওয়ার খোলনলচে পাল্টে দিয়েছে।”একইসঙ্গে মনে করিয়ে দিচ্ছে টেক্সাসের কয়েকদিন আগের বন্যা পরিস্থিতি, যেখানে এক সপ্তাহ আগেই মৃত হয়েছেন ১৭ জনেরও বেশি মানুষ। বহু পরিবার এখনও ঘরছাড়া। ঠিক সেই পরিস্থিতিরই ছায়া যেন দেখা যাচ্ছে নিউ ইয়র্ক ও নিউ জার্সিতে। ইতিমধ্যেই উদ্ধার কাজ শুরু হয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। জাতীয় রক্ষীবাহিনী এবং বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী (FEMA) বহু মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। ব্রঙ্কসের বাসিন্দা ড্যানিয়েল ক্লার্ক বলেন, “আমার স্ত্রী অসুস্থ। হাসপাতালে নিয়ে যেতে গাড়ি ডাকতে পারিনি। এরপর ন্যাশনাল গার্ড এসে আমাদের উদ্ধার করে। ওরা না থাকলে কী হত ভাবতেই পারছি না।”

সোশ্যাল মিডিয়াতে ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে জলমগ্ন মেট্রো স্টেশনের ছবি, যেখানে যাত্রীরা হাঁটু জল ঠেলে ট্রেন ধরার চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ রাস্তায় ডিঙি চালিয়ে অফিসে যাচ্ছেন, আবার কেউ নৌকা বানিয়ে বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দিচ্ছেন। এই সব ছবি যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে ২০২১ সালের নিউ ইয়র্ক বন্যার স্মৃতি, যেখানে হারিকেন ইডার প্রভাবে শহর একদিনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল।এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন দিনমজুর, ট্যাক্সি চালক, হোটেল কর্মী ও নিম্নআয়ের মানুষজন। জলের জন্য কাজ করতে না পারায় রোজগারে টান পড়ছে। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যবসা। নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কোয়ারের এক দোকানদার বলেন, “গত ৩ দিন ধরে দোকান খুলতেই পারিনি। ভিজে গিয়েছে সব মালপত্র। ক্ষতির অঙ্ক এখনও হিসেব করা যায়নি।”উন্নত প্রযুক্তির শহর হলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সামনে মানুষের অসহায়ত্ব আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এই ঘটনা। প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে, পরিকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে জলনিকাশির ব্যবস্থা আরও উন্নত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে আরও এই ধরনের দুর্যোগ এড়াতে তৈরি হচ্ছে নতুন রেসপন্স প্ল্যান।পরিস্থিতি এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় নতুন করে জল জমছে বিভিন্ন জায়গায়। তবে স্বস্তির খবর, এখনও পর্যন্ত কোনও মৃত্যুর খবর মেলেনি। নিউ ইয়র্কাররা সাহস হারাচ্ছেন না। “আমরা অভ্যস্ত নয় এই পরিস্থিতিতে, কিন্তু আমরা লড়াই করতে জানি,” বলছেন কলেজ ছাত্রী লিসা চ্যাং।সব মিলিয়ে বলা যায়, একদিকে যেমন প্রকৃতির রুদ্ররূপে কাঁপছে নিউ ইয়র্ক ও নিউ জার্সি, তেমনই অন্যদিকে মানবিকতা, সাহস, সহানুভূতি ও একে অপরের পাশে দাঁড়ানোর বার্তা দিচ্ছে এই শহর। এটি শুধু একটি আবহাওয়া সংক্রান্ত খবর নয়, এটি শহরের ধৈর্য, লড়াই এবং পুনরুদ্ধারের গল্প।