Thursday, July 10, 2025
Google search engine
Homeটপ 10 নিউসসমাজ তথা পরিবেশকে রক্ষায় ব্রতী হলদিয়ার নকুল বাবু

সমাজ তথা পরিবেশকে রক্ষায় ব্রতী হলদিয়ার নকুল বাবু

Nakul Babu of Haldia, a devotee of protecting society and the environment:-সমাজে এমন কিছু মানুষ থাকেন, যাঁরা নিজেদের কাজের মাধ্যমে শুধুই রুটি-রুজির ব্যবস্থা করেন না, বরং সমাজ ও পরিবেশের জন্য এক অবিচ্ছিন্ন দায়বদ্ধতা নিয়ে এগিয়ে যান। তাঁরা নিজেদের ছোট্ট জীবনের পরিধিকে বড় এক উদ্দেশ্যের সঙ্গে জুড়ে দেন। হলদিয়ার সুতাহাটা ব্লকের অনন্তপুর গ্রামের নকুলচন্দ্র ঘাঁটি ঠিক তেমনই একজন মানুষ। ৫২ বছর বয়সী এই ব্যক্তি একদিকে যেমন পেশায় হলদিয়ার একটি বেসরকারি শিল্প সংস্থার কর্মী, অন্যদিকে তিনি হলেন এই জেলার একজন বিখ্যাত “স্নেকম্যান”, যিনি সমাজ সংস্কার, যুক্তিবাদ এবং বন্যপ্রাণ রক্ষায় নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করেছেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন সমাজ ও প্রকৃতির উদ্দেশ্যে এক অঘোষিত অর্ঘ্য।

WhatsApp20Image202025 07 1020at2017.21.35 44987117 scaled

২০০৬ সালে ‘সাপের ঘরে মানুষ’ নামক একটি প্রদর্শনীতে অংশ নিয়ে সাপ রক্ষার বিষয়ে তাঁর আগ্রহের সূত্রপাত হয়। সেই এক মেলামঞ্চ থেকে শুরু করে আজ অবধি তিনি এক হাজারেরও বেশি সাপের প্রাণ বাঁচিয়েছেন— যার অধিকাংশই ছিল বিষধর এবং প্রাণঘাতী। বাঁচানো সাপগুলির মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ বন দফতরের হাতে তুলে দিয়েছেন এবং বাকি সাপগুলিকে নিজে নিরাপদ পরিবেশে ছেড়ে দিয়েছেন। এই কাজটি তিনি কখনও নিজের প্রচারের জন্য করেননি, বরং মানুষের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য করেছেন। একসময় এই অঞ্চলগুলিতে সাপের কামড়ে বহু মৃত্যু হত, আর ওঝা নামক তথাকথিত ‘চিকিৎসকদের’ অজ্ঞানতা সেই মৃত্যুর মিছিল আরও দীর্ঘতর করত। ঠিক এই অন্ধকার সময়েই নকুলচন্দ্র যুক্তিবাদী মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সরাসরি জনমনে সচেতনতা গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। ১৯৮৬ সাল থেকেই যুক্তিবাদী মঞ্চের সক্রিয় সদস্য হিসেবে, তিনি কুসংস্কার বিরোধী লড়াইয়ে নেমে পড়েন।

পাড়ায় পাড়ায়, গ্রামে গ্রামে সভা করে মানুষকে বোঝান যে ওঝার ঝাড়ফুঁকে প্রাণ রক্ষা নয়, মৃত্যুর পরোয়ানা লেখা হয়। তিনি বলেন, “প্রাণ রক্ষা করতে হলে চাই বিজ্ঞান ও যুক্তি, ভগবানের নাম নয়।” শুধু বন্যপ্রাণ বা সাপ রক্ষা করেই থেমে থাকেননি তিনি। ২০২২ সালে নিজের ছেলের মৃত্যুর পর তিনি নিজেই পুত্রবধূর পুনরায় বিবাহ দেন। সমাজ যেখানে বিধবাদের বিবাহকে আজও চোখ কুঁচকে দেখে, সেখানে তিনি নিজে দাঁড়িয়ে ১০ জন বিধবার বিবাহে সহায়তা করেন। এমনকি নিজের দুই ভাইপোকেও বিধবা মহিলাদের সঙ্গে বিবাহে সম্মত করান। তাঁর লক্ষ্য, জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত অন্তত ২৫ জন বিধবার পুনরায় বিবাহের ব্যবস্থা করা। নকুল বাবুর মতে, “একটা মেয়ের জীবন শুধু স্বামীর সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে পারে না। সে মানুষ, তারও নতুন করে বাঁচার অধিকার আছে।

WhatsApp20Image202025 07 1020at2017.21.46 2a86250f

” তাঁর এই কর্মকাণ্ড শুধু ওই নারীদের জীবন নয়, সমাজকেও এক অন্য আলো দেখিয়েছে। অনন্তপুর গ্রামে তাঁর বাড়ির সামনে আজ বহু মানুষ ভিড় জমান, কেউ অসুস্থ সাপ নিয়ে, কেউ পরিবারে বিধবা পুত্রবধূর ভবিষ্যৎ নিয়ে পরামর্শ নিতে। অনেক সময় নিজের ছুটি বা রাত্রির বিশ্রাম ত্যাগ করে তিনি ছুটে যান সাপ ধরতে কিংবা কাউকে বিয়েতে সাহায্য করতে। আর এসব কিছুতেই কোনওরকম অর্থ বা পুরস্কারের প্রত্যাশা নেই তাঁর। শুধু একটা দায়বদ্ধতা— সমাজের কাছে, প্রকৃতির কাছে, মানুষের কাছে। স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য রঞ্জন দাস বলেন, “নকুলদা আমাদের এলাকার গর্ব। উনি একা হাতে যা করছেন, তা অনেক সরকারি প্রকল্পও করতে পারে না।” বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞ ডঃ দিবাকর সাহাও জানান, “ওঁর মতো মানুষ না থাকলে গ্রামেগঞ্জে সাপের জন্য প্রাণদান আরও বাড়ত। উনি শুধু প্রাণ বাঁচাচ্ছেন না, সচেতনতা ছড়াচ্ছেন।” শুধু পুরুষ বা স্থানীয় প্রশাসন নয়, গ্রামের মহিলারাও তাঁর এই উদ্যোগে পাশে দাঁড়িয়েছেন। এক বিধবা, যাঁর বিয়েতে নকুলচন্দ্র সহায়তা করেছিলেন, বলেন, “আমার জীবনে আবার আলো ফিরেছে ওনার জন্য। আমি আজ আবার মানুষ হিসেবে বাঁচছি।” কেবল মাত্র যুক্তিবাদ বা বিজ্ঞানমনস্কতা নয়, তাঁর ভিতর রয়েছে এক গভীর মানবিকতা। আর সেটাই তাঁকে আলাদা করে তোলে। নকুল বাবুর মতো মানুষেরা আমাদের মনে করিয়ে দেন— আসল পরিবর্তন আসে নিচু স্তর থেকে, সাধারণ মানুষের চেতনার বদলের মধ্য দিয়ে। তাঁদের কাজ কোনো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু না হলেও, একদিন তাঁদের নিয়েই তৈরি হবে আমাদের সমাজের সোনালি ইতিহাস। আমাদের প্রত্যেকের উচিত এমন মানুষের পাশে থাকা, তাঁদের উৎসাহ দেওয়া এবং তাঁদের কাজকে সমাজের মূল স্রোতে নিয়ে আসা। কারণ এই ‘নাম না জানা নায়কেরাই’ একদিন বদলে দিতে পারে গোটা পৃথিবীকে।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments