Nadia doctor sets example of successful multiple angiograms in a short period of time : খুব সাধারণ এক সকাল, কল্যাণী গান্ধী মেমোরিয়াল হাসপাতালের ওয়ার্ডে তখন রোগীর লাইন যেন অগুনতি নদীর মতো বয়ে চলেছে—হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রাজ্যের নানা প্রান্ত থেকে এসেছেন মানুষজন, কেউ নদীয়া, কেউ মুর্শিদাবাদ, কেউবা উত্তর ২৪ পরগণা বা হুগলি থেকে, আর কেউ কেউ তো এসেছেন এমনকি রাজ্যের বাইরের জেলা থেকেও। এই রোগীদের একটাই সমস্যা—হৃদযন্ত্রে কোনও না কোনও গন্ডগোল, আর সমাধানের প্রথম ধাপ, এনজিওগ্রাম। কিন্তু এত রোগী একসঙ্গে! এতগুলো এনজিওগ্রাম কি একদিনে সম্ভব? যেখানে বেসরকারি হাসপাতালে একটি এনজিওগ্রাম করতে হাজার হাজার টাকা খরচ হয়, আর তার জন্য অপেক্ষা করতে হয় সপ্তাহের পর সপ্তাহ, সেখানে রাজ্যের একমাত্র সরকারি হার্ট হাসপাতাল কল্যাণী গান্ধী মেমোরিয়ালে মাত্র ৯ ঘণ্টায় একটানা ১০৯টি এনজিওগ্রাম করে নজির গড়লেন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. চন্দন মিশ্র এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন একটি ছোট্ট অথচ দক্ষ চিকিৎসকদল। ৫ জন চিকিৎসক, ২ জন টেকনিশিয়ান ও কিছু নার্সিং স্টাফ—এই ছোট্ট টিমই যেন অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখালো। এমন নজির তো বেসরকারি ক্ষেত্রেও বিরল, আর সেখানে সরকারিভাবে, তাও একেবারে বিনামূল্যে! এটা কেবল একদিনের ঘটনা নয়, এটা একটা দৃষ্টান্ত—যেখানে চিকিৎসা শুধুই পেশা নয়, হয়ে ওঠে মানবতার সেবার সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ। এই ১০৯ জন রোগীর মধ্যে ৯৫ জন পুরুষ, ১৪ জন মহিলা। প্রত্যেকের জন্য নির্ধারিত হয়েছে সুনির্দিষ্ট ও নিখুঁত পদ্ধতি—নির্বিঘ্নে, নিঃসন্দেহে, আর সবথেকে বড় কথা, সম্পূর্ণ সাফল্যের সঙ্গে। একজন রোগী মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জ থেকে আসা গণেশ হালদার বলেন, “আমি তো ভাবতেই পারিনি এত তাড়াতাড়ি আমার এনজিওগ্রাম হবে, তাও বিনা খরচে। এই হাসপাতাল, এই ডাক্তারদের আমি সারাজীবন মনে রাখব।” অন্যদিকে একজন রোগীর মেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমার বাবার খুব কষ্ট হচ্ছিল, টাকার জন্য আমরা বেসরকারি হাসপাতালে যেতে পারিনি। গান্ধী মেমোরিয়াল আমাদের বাঁচিয়েছে।” চিকিৎসক চন্দন মিশ্র বলেন, “আমি একা কিছু নই, আমার টিম ছাড়া এটা সম্ভব ছিল না। হাসপাতালের সুপার সাহেব আমায় প্রথমে সাহস দিয়েছিলেন, তিনিই বলেছিলেন, একদিনে একাধিক এনজিওগ্রাম করতে গেলে আমরা পাশে থাকব। আর সেটা যেন বাস্তব হয়ে গেল। এমনকি দেশের বাইরের দু-একজন রোগীকেও আমরা এনজিওগ্রাম করতে পেরেছি।” হাসপাতালের সুপার ডা. আশিস মৈত্র বলেন, “আমাদের পরিকাঠামো সীমিত হলেও আমরা চেষ্টা করি সর্বোচ্চটুকু দেওয়ার। রোগীর সংখ্যা বাড়ছিল, তখন চন্দনদার সঙ্গে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত নিই, যে একসঙ্গে এতগুলো এনজিওগ্রাম করব। এটা শুধু রেকর্ড নয়, মানুষের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা।”
এই ঘটনা এখন শুধু স্থানীয় এলাকায় নয়, গোটা রাজ্যে চর্চার বিষয়। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছেন, সরকারি হাসপাতাল মানেই ‘ঘুষ’, ‘অসুবিধা’, বা ‘অবহেলা’ নয়—যদি ইচ্ছে থাকে, পরিকল্পনা থাকে আর নেতৃত্বে থাকেন দক্ষ চিকিৎসক, তাহলে সেখানেও বিশ্বমানের চিকিৎসা পাওয়া যায়। যারা এতদিন ধরে চিকিৎসার জন্য কলকাতার বেসরকারি হাসপাতালে দৌঁড়েছেন, এই ঘটনায় তাঁদের মনে ভরসা তৈরি হয়েছে। এটি সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার প্রতি মানুষের আস্থা ফেরাতে বড় পদক্ষেপ। চিকিৎসা জগতে এটি শুধু একটি চিকিৎসা সাফল্য নয়, এটি মানবিকতার এক অভাবনীয় জয়। এই রেকর্ড শুধু কাগজে লেখা থাকবে না, মানুষের মুখে মুখে, কৃতজ্ঞতার সুরে উচ্চারিত হবে—ডা. চন্দন মিশ্রের নাম, গান্ধী মেমোরিয়াল হাসপাতালের নাম।
তবে এই ঘটনা ভবিষ্যতের জন্য আরও বড় বার্তা রেখে যায়। হাসপাতালের পরিকাঠামো যদি আরও শক্তপোক্ত হয়, চিকিৎসকদের যদি যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সুযোগ দেওয়া হয়, তাহলে এমন দৃষ্টান্ত আরও গড়া সম্ভব। সরকার যদি এই ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই মডেলকে অন্যান্য সরকারি হাসপাতালে প্রয়োগ করে, তাহলে একদিন হয়তো স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চেহারাই বদলে যাবে। সেদিন হয়তো আর কেউ বলবে না ‘সরকারি হাসপাতাল মানেই ঝামেলা’।

এই ঘটনা নতুন প্রজন্মের চিকিৎসকদের জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে, যারা ভাবেন শুধুই বিদেশে বা প্রাইভেট সেক্টরে গিয়ে সফল হওয়া যায়। না, যদি ইচ্ছে থাকে মানুষের পাশে দাঁড়াবার, তাহলে নিজের রাজ্যের মাটিতেই গড়া যায় এমন সাফল্যের রেকর্ড।
শেষ কথা একটাই—হাসপাতাল মানে শুধু দেওয়াল আর যন্ত্রপাতি নয়, সেটা গড়ে ওঠে মানুষের জন্য, মানুষের হাতে, আর মানুষের ভালবাসা দিয়েই। সেই ভালবাসাই যেন আজ ৯ ঘণ্টায় ১০৯ জন হৃদরোগীর হৃদয় স্পর্শ করেছে।