Multiple venomous cobras in central correctional facility, inmates in panic:-জেল মানেই শাস্তি আর সংশোধনের কেন্দ্র, যেখানে বন্দীরা তাদের অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করে সমাজে ফিরে আসার সুযোগ পায়। কিন্তু জলপাইগুড়ির কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে এখনকার পরিস্থিতি ঠিক যেন এক বিভীষিকাময় জায়গার রূপ নিয়েছে। শাস্তির ভয়ে নয়, প্রাণ হারানোর আশঙ্কায় ঘুম উড়েছে বন্দী ও কর্মীদের। কারণ শনিবার সকালে সংশোধনাগার চত্বর থেকে একসঙ্গে উদ্ধার হয়েছে বিষাক্ত কোবরা সাপের একের পর এক ছানা— সংখ্যাটি আট! চারিদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, কেউ জানালার ধারে বসতে সাহস পাচ্ছেন না, আবার কেউ কম্বলের নিচে লুকিয়ে কাটাচ্ছেন রাত।ঘটনার সূত্রপাত সংশোধনাগারের একটি পুরনো পাইপ বস্তুর ভিতর থেকে। সকালবেলায় বন্দীরা নিজেদের দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যস্ত থাকার সময় আচমকাই এক বন্দীর নজরে পড়ে নড়াচড়া করা কিছু প্রাণী। প্রথমে কেউ গুরুত্ব না দিলেও, কয়েক মিনিটের মধ্যে সেই নড়াচড়া বিষধর সাপের ছানা বলেই নিশ্চিত হন সংশোধনাগারের এক নিরাপত্তারক্ষী। মুহূর্তেই চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে গোটা জেলে। আতঙ্কে কয়েকজন বন্দী চিৎকার করতে শুরু করেন। তৎক্ষণাৎ কারা কর্তৃপক্ষ পরিবেশকর্মী তথা অভিজ্ঞ সাপ উদ্ধারকারী বিশ্বজিৎ দত্ত চৌধুরির সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি ঘটনাস্থলে এসে উদ্ধার করেন আটটি বিষধর ‘স্পেকটাকল্ড কোবরা’ (Spectacled Cobra) ছানা।

বিশ্বজিৎবাবু জানান, “এগুলি সদ্য জন্মানো কোবরা ছানা, তবে বিষের পরিমাণ অনেক বেশি। এদের কামড় মারাত্মক হতে পারে। সাধারণত একটি মা কোবরা ২০ থেকে ২৫টি ডিম পাড়ে, তার মধ্যে গড়ে ২৩টি ছানার জন্ম হয়। এর মধ্যে মাত্র ৮টি ধরা পড়েছে, বাকি ছানাগুলি এখনও আশেপাশে কোথাও লুকিয়ে থাকতে পারে।” তিনি আরও বলেন, “এই সাপের প্রজাতি সাধারণত নিরিবিলি, আর্দ্র এবং অন্ধকার জায়গা পছন্দ করে। সংশোধনাগারের কিছু পুরনো নির্মাণ এবং অপরিষ্কার নিকাশি পাইপ এই ধরনের পরিবেশের অনুকূল।”ঘটনার গুরুত্ব বুঝে দ্রুত ব্যবস্থা নেয় সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষ। গোটা জেল চত্বর জুড়ে শুরু হয় তল্লাশি অভিযান। কর্মীরা টর্চ হাতে ঘুরে ঘুরে খুঁজে দেখছেন প্রতিটি কোণ, খোলা পাইপ, রান্নাঘর, জলাশয় সংলগ্ন এলাকা, এমনকি বন্দীদের সেলেও নজর রাখা হচ্ছে। বন্দীদের একাংশ অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে। কারা সুপার দেবব্রত সরকার জানান, “আমরা নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছি। সাপ ধরা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হয়েছে। পাশাপাশি পুরো জেল চত্বর পরিষ্কার করার কাজ শুরু হয়েছে।”এই ঘটনায় কারা দফতরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও উদ্বিগ্ন। উত্তরবঙ্গের ডিআইজি (কারা) একে ‘গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তাজনিত বিপদ’ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, “সংশোধনাগার মানে বন্দীদের নিরাপদে রাখার জায়গা। সেখানে বিষাক্ত সাপের অস্তিত্ব মানে চরম প্রশাসনিক ব্যর্থতা। আমরা পুরো বিষয়ে উচ্চপর্যায়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি।”
এদিকে বন্দীদের পরিবার পরিজনদের মধ্যে উদ্বেগ বেড়েছে। জলপাইগুড়ির বাসিন্দা সোমা মণ্ডল, যাঁর স্বামী এই সংশোধনাগারে বন্দী, বলেন, “তাঁকে তো শাস্তি হয়েছে, কিন্তু সাপের কামড়ে মারা যাওয়া তো শাস্তি নয়! সরকার কি দায় নেবে?”পরিবেশবিদরাও এই ঘটনাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তাঁদের মতে, বনভূমি ও জলাভূমি কেটে ফেলায় সাপেরা নিরাপদ আশ্রয় খুঁজতে শহরের দিকে চলে আসছে। তাছাড়াও, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব, খোলা নিকাশি, ও পুরনো জলাশয়কে অবহেলা করলে এমন সমস্যাই সামনে আসে।বিশ্বজিৎ দত্ত চৌধুরির মতে, “এটা একটা প্রাকৃতিক সতর্কবার্তা। আমরা যতই সভ্যতা গড়ে তুলি, প্রকৃতিকে অবহেলা করলে প্রকৃতিই তার প্রতিশোধ নেয়। সংশোধনাগার কর্তৃপক্ষের উচিত নিয়মিত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা ও নিয়মিত সাপের উপস্থিতি খতিয়ে দেখা।”

এই ঘটনা থেকেই বড় প্রশ্ন উঠে আসে— বন্দীদের সুরক্ষা কোথায়? সংশোধনাগারে যেখানে নিয়মিত নিরাপত্তা রক্ষা হওয়া উচিত, সেখানে একের পর এক কোবরা ছানার উপস্থিতি কি শুধুই একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? নাকি এ থেকেই স্পষ্ট, সংশোধনাগারগুলিতে সুরক্ষাব্যবস্থা কতটা নড়বড়ে?বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে এই ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে কারা ব্যবস্থাকে আরও উন্নত প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষিত কর্মী দিয়ে সাজাতে হবে। শুধু বন্দী নয়, কর্মী ও নিরাপত্তারক্ষীদেরও সাপ কিংবা অন্যান্য বিপজ্জনক প্রাণীর বিষয়ে প্রাথমিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক।বিচারব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত সংশোধনাগার যদি নিজেই মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়, তবে সংশোধনের সেই প্রক্রিয়া আর কতটা কার্যকর তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। এই ঘটনাটি আবারও প্রমাণ করে দেয়, আমরা যতই আধুনিক সমাজের দাবি করি, প্রকৃতির সঙ্গে তাল না মিলিয়ে চললে সেই সভ্যতা কোনও সময়ে নিঃস্ব হয়ে যেতে পারে।