Military fire, oil cylinder burst:কলকাতার বুকে আবারও নেমে এল ভয়াল আগুনের বিভীষিকা। গতকাল রাত প্রায় ১১টা নাগাদ ইএম বাইপাস সংলগ্ন মেট্রোপলিটনের ঝুপড়ি এলাকায় আচমকা আগুন লেগে যায়, আর তার পরের ঘটনা যেন এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন। রাতের শহর যখন ঘুমিয়ে, ঠিক তখনই ঘুম ভাঙে এলাকাবাসীর, আগুনের লেলিহান শিখা আর কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যায় গোটা এলাকা। প্রায় ১৫ থেকে ২০টি ঝুপড়ি মুহূর্তের মধ্যেই আগুনের গ্রাসে চলে যায়। স্থানীয়দের দাবি, গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে যাওয়ার ফলে আগুনের তীব্রতা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যেই মাথার উপর ছাদটা নেই হয়ে গেল। যারা একটু আগেই নিজের ঘরে বসে রাতের খাবার খাচ্ছিলেন, তাদের কেউ কেউ প্রাণ হাতে করে শুধু গা বাঁচিয়ে বেরিয়ে এসেছেন, আর যারা পারেননি, তারা হারালেন সব—ঘর, জিনিসপত্র, স্মৃতি, ভবিষ্যৎ—সব।
স্থানীয় এক বাসিন্দা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “ভাই, আমাদের সব শেষ। আমি বাচ্চাদের নিয়ে শুধু একটা জামা গায়ে দিয়ে বেরিয়ে এসেছি। সব পুড়ে গেছে। এইটা দেখুন, আমার ছেলের ছোটবেলার পোড়া জামা, এটুকুই পেয়েছি ছাইয়ের মধ্যে হাতড়ে। আমার গয়নাগাটি, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, স্কুলের বইখাতা—সব ছাই হয়ে গেছে। মেয়েদের সামনে পরীক্ষা, ওরা কাঁদছে। এখন কিভাবে পড়বে?”
আগুনের তীব্রতা এতটাই ছিল যে, কলকাতা পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীকেও ডেকে পাঠাতে হয়। দমকলের চারটি ইঞ্জিন একযোগে প্রায় দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়, কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। ঘটনাস্থলে হাজির ছিলেন দমকল আধিকারিক শ্রী রাজীব ঘোষ, তিনি জানান, “আগুন ছড়ানোর পেছনে মূল কারণ গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ। ঝুপড়ি এলাকায় একাধিক রান্নার সিলিন্ডার একসঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটায় আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে।”
স্থানীয় কাউন্সিলর, ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল নেতা সচিন সিংহকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নতুন করে ক্ষোভ। অনেকে অভিযোগ করেছেন, “ওই ময়দানে মাসে মাসে টাকা তোলা হয়। ঝুপড়ি বসানোর অনুমতি দিয়ে গেছে রাজনৈতিক নেতারা। এখন এই আগুন লাগার পর কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। আগেও নারকেলডাঙায় একই ঘটনা হয়েছিল, তখনও কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল। এখন আবার সেই একই ঘটনা, কেউ দায়িত্ব নিচ্ছে না।”
তবে কলকাতা পুরসভার মেয়র ফিরহাদ হাকিম বলছেন, “কোনও রকম রাজনীতিতে যাব না। মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের পাশে দাঁড়ানোই এখন মূল কাজ। আইন অনুযায়ী তদন্ত হবে।” যদিও এলাকাবাসীর একাংশ বলছেন, “মেয়র এলাকা ছাড়তেই শুরু হয়ে গেল অশান্তি, পুলিশের সামনেই দুই পক্ষের মারামারি চলছে, কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে উঠছে চোর চোর স্লোগান। আমরা শান্তি চাই, নিরাপত্তা চাই।”
এই একই ছবিটা আমরা কিছুদিন আগেও দেখেছিলাম নারকেলডাঙায়। তখনও এক রাতের মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল ৩০টিরও বেশি ঝুপড়ি। সেবার একজনের মৃত্যু হয়, যিনি ঘুমের মধ্যেই অগ্নিদগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান। এক মহিলা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, “নব্বই টাকা বার করতে পেরেছি ছাইয়ের মধ্য থেকে। আমার বাড়ি, সংসার, গয়নাগাটি, সব শেষ। ভাবিনি এক রাতেই এমন বদলে যাবে জীবন।”

অগ্নিকাণ্ডের পরে ঝুপড়ির মধ্যে যারা বাস করতেন, তারা আশেপাশের স্কুলে বা খোলা জায়গায় কোনওরকমে মাথা গুঁজে রয়েছেন। খাওয়া নেই, পানি নেই, ছোটো ছোটো শিশুদের চোখে জল, সামনে পরীক্ষা থাকা মেয়েরা বই হারিয়ে দিশেহারা। স্থানীয় এক শিক্ষিকা বললেন, “আমরা চেষ্টা করছি নতুন করে বই জোগাড় করে দিতে। কিন্তু পড়ার পরিবেশটাই নেই এখন। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে ওরা।”
এই ঘটনার ভবিষ্যৎ প্রভাব অত্যন্ত গভীর। আবার প্রশ্ন উঠেছে, কেন শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এতো ঝুপড়ি, কেন যথাযথ অগ্নি নিরাপত্তা নেই, কেন সময়মতো পৌঁছয় না দমকল বাহিনী? একজন সমাজকর্মী বললেন, “বারবার বলা হচ্ছে আগুনে পুড়ল, দমকল দেরিতে এলো। একটা জরুরি ব্যবস্থাপনা নেই কেন? রাজনৈতিক স্বার্থে ঝুপড়ি বসানোর অনুমতি দেওয়া হয়, আর বিপদে সবাই মুখ লুকোয়।”
অন্যদিকে, প্রশাসনের তরফ থেকে জানানো হয়েছে, ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য অস্থায়ী আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। খাবার, পোশাক ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করা হবে। কিন্তু প্রশ্ন রয়ে যায়, এই ক্ষয়ক্ষতির ক্ষত কতদিনে মুছবে? এক শিশুর হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন এক মহিলা, তাঁর কথায়, “জীবন তো থেমে থাকবে না। কিন্তু এই ঘা ভুলবো কিভাবে?”
এই ঘটনাটি শুধু একটি অগ্নিকাণ্ড নয়, এটি শহরের গরিব মানুষের নিরাপত্তাহীনতার, রাজনৈতিক অবহেলার, আর আমাদের সামগ্রিক নাগরিক পরিকাঠামোর এক করুণ প্রতিচ্ছবি। আগুন নিভে গেছে, কিন্তু দগ্ধ হয়েছে মানুষের জীবন, স্বপ্ন আর ভবিষ্যৎ। প্রশাসনের উচিত এবার সত্যিই কিছু করা—শুধু রাজনীতি না করে, বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করে এইসব গরিব মানুষের পাশে দাঁড়ানো। আগুন পুড়িয়ে দিয়েছে শুধুই ঘর নয়, জ্বলেছে বিশ্বাস, নিরাপত্তা আর শৈশব।