Thursday, May 22, 2025
Google search engine
Homeপশ্চিমবঙ্গকলকাতানবাবের জেলায় আপেল ফলিয়ে তাক লাগালেন মাস্টারমশাই

নবাবের জেলায় আপেল ফলিয়ে তাক লাগালেন মাস্টারমশাই

Master Mashai grows apples in Nawab’s district and puts them on shelves : মালদা আর মুর্শিদাবাদ—এই দুই জেলার নাম উঠলেই মনে পড়ে আম আর লিচুর কথা। কিন্তু সেই আমের পীঠস্থান মুর্শিদাবাদেই এবার ইতিহাস গড়লেন এক সাধারণ স্কুলশিক্ষক। বেলডাঙ্গার কাছাড়িপাড়ার বাসিন্দা রূপেশ দাস, পেশায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক, কিন্তু তাঁর হাত ধরেই এবার গ্রীষ্মপ্রধান বাংলার বুকে শীতপ্রধান দেশের ফল আপেলের অভাবনীয় ফলন সম্ভব হয়েছে। চারদিকে যখন দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ, তখন তাঁর বাগানের আপেল সুগন্ধি রসে টইটম্বুর। মাস্টারমশাইয়ের এই অদম্য প্রয়াসে শুধু জেলার মানুষই নয়, কৃষি দপ্তরের আধিকারিকরাও অবাক। রূপেশবাবুর আপেল এখন হয়ে উঠেছে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। তিনি জানিয়েছেন, প্রায় পাঁচ বছর আগে হিমাচল প্রদেশ থেকে তিন প্রজাতির আপেল চারা—হরিমন ৯৯ (দেশীয়), এনা (ইজরায়েলি), এবং ডরসেট গ্লোডেন (বাহামা)—অনলাইনে এনে বাগানে লাগিয়েছিলেন।

তারপরে নিয়মিত পরিচর্যা করে, প্রুনিং ও সঠিক চিলিং পিরিয়ড মেনেই গাছের বৃদ্ধির দিশা দিয়েছেন। রূপেশ দাস বলছেন, “গরমের দেশে আপেল ফলানো সহজ কাজ নয়। কিন্তু আমি চ্যালেঞ্জটা নিতে চেয়েছিলাম। যেহেতু গাছ ফলন দিতে শুরু করে দ্বিতীয় বছর থেকেই, তাই আমি জানতাম ধৈর্য রাখতে হবে। এখন মানুষ আমার বাগানে এসে নিজের চোখে দেখে যাচ্ছেন আপেল ঝুলছে ডালে ডালে।” তিনি আরও বলেন, “চিলিং পিরিয়ড মানে ৫০ থেকে ১০০ ঘণ্টা ৭-১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা দরকার। তাই ডিসেম্বর-জানুয়ারির ঠান্ডাকেই কাজে লাগাতে হয়। আর প্রুনিং—গাছের ডাল ছাঁটাই—নিয়ম মেনে না করলে ভালো ফলন সম্ভব নয়।” তার এই চেষ্টায় আজ তার বাগান দেখার জন্য জেলাজুড়ে কৌতূহলী মানুষ ভিড় করছেন। স্কুলপড়ুয়া, সাংবাদিক, কৃষি আধিকারিক থেকে শুরু করে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, “রূপেশ দার এই সাফল্য প্রমাণ করে দিলো, ইচ্ছাশক্তি থাকলে অসম্ভব কিছুই নেই।”

Z

কাছাড়িপাড়ার বাসিন্দা তপন শেখ বলেন, “আমি ভাবতেই পারিনি আমাদের এই গরমের মাটিতে আপেল ধরতে পারে! এখন নিজের চোখে দেখে যেন স্বপ্ন দেখছি।” স্থানীয় কৃষি আধিকারিক মৃণাল সাহা জানিয়েছেন, “রূপেশবাবুর এই প্রচেষ্টা কৃষির জগতে একটা দৃষ্টান্ত। এই সফলতা অনেক কৃষককে অনুপ্রাণিত করবে। আমরা তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে অন্য এলাকাতেও পরীক্ষামূলকভাবে এই চারা লাগানোর কথা ভাবছি।” কৃষি দপ্তরের তথ্য বলছে, পশ্চিমবঙ্গে আপেল ফলানো এতদিন ধরে প্রায় অসম্ভব বলে ধরে নেওয়া হতো। কারণ এই ফল মূলত হিমালয় ঘেঁষা অঞ্চল, যেমন কাশ্মীর বা হিমাচল প্রদেশে ভালো জন্মায়, যেখানে বছরের একটা বড় সময় ঠান্ডা থাকে। কিন্তু রূপেশ দাস সেই ধারণা ভেঙে দিয়েছেন। তাঁর বাগানে আপেলের রঙ, গন্ধ, স্বাদ—সবকিছুতেই যেন শীতপ্রধান দেশের আপেলকে টেক্কা দেয়। রূপেশবাবুর স্ত্রী মমতা দাস জানিয়েছেন, “ও অনেক দিন ধরে রাত জেগে ইউটিউব দেখে, চাষ নিয়ে পড়াশোনা করে। আমি বলতাম—সব হবে? কিন্তু এখন আমি ওর পাশে গিয়ে দেখি গাছে ঝুলছে একের পর এক লাল টসটসে আপেল। গর্বে বুক ভরে যায়।

” এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ধরনের চাষ কি অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়ানো সম্ভব? কৃষিবিদরা মনে করছেন, যদি সঠিক চারা, জলনিকাশি ব্যবস্থা এবং প্রুনিং-চিলিং এর হিসেব রাখা যায়, তাহলে এই আপেল চাষ বাংলার বিভিন্ন গ্রীষ্মপ্রধান জেলাতেও সম্ভব। ভবিষ্যতে এই পদ্ধতি যদি সফলভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে বাংলার কৃষি চিত্র পাল্টে যেতে পারে। আপেল, যেটা এতদিন বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো, সেটা যদি নিজেদের রাজ্যে চাষ হয়, তাহলে অর্থনীতি থেকে শুরু করে কৃষকদের আর্থিক স্বনির্ভরতা—সবকিছুর ক্ষেত্রেই এক নতুন দিগন্ত খুলে যাবে। পাশাপাশি, এই উদ্যোগের একটা বড় দিক হলো—ছাত্রদের মধ্যেও একরকম উৎসাহ তৈরি হয়েছে। রূপেশ দাস শিক্ষক হওয়ার সুবাদে নিজের ছাত্রছাত্রীদের কৃষির দিকে আগ্রহী করে তুলছেন। ক্লাসরুমে পড়ানোর পাশাপাশি এখন তিনি তাঁদের নিয়ে যাচ্ছেন বাগানে, দেখাচ্ছেন বাস্তব উদাহরণ। তাই এই আপেল চাষ শুধু কৃষি নয়, শিক্ষা ক্ষেত্রেও এক নতুন চিন্তার রসদ জোগাচ্ছে। তিনি বলেন, “শিক্ষা শুধু বইয়ে সীমাবদ্ধ নয়। প্রকৃতি থেকে, অভিজ্ঞতা থেকে শেখাটাও গুরুত্বপূর্ণ। আমি চাই আমার ছাত্রছাত্রীরা জানুক, হাতেকলমে কাজ করেই সাফল্য আসে।”

মুর্শিদাবাদের বুকে এই আপেল চাষের সাফল্য যেমন আশার আলো দেখাচ্ছে, তেমনই উদ্দীপনা জোগাচ্ছে অন্যান্য কৃষকদের। ইতিমধ্যেই কয়েকজন চাষি রূপেশবাবুর কাছ থেকে আপেলের চারা সংগ্রহ করতে শুরু করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, আগামীতে আরও বড় পরিসরে চারা উৎপাদন করে জেলার অন্যান্য অংশে পৌঁছে দিতে চান। বাংলা আর আম-লিচুর জন্য বিখ্যাত থাকবে ঠিকই, কিন্তু সেই সঙ্গে থাকবে গরমের দেশে শীতল আপেলের আশ্চর্য সফলতাও। এবং তার পুরোভাগে থাকবেন—’নবাবের জেলায় আপেল ফলিয়ে তাক লাগানো’ সেই মাস্টারমশাই, রূপেশ দাস।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments