Low pressure and heavy rain forecast in South Bengal:আষাঢ়-শ্রাবণের বর্ষাকাল বাঙালির জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কখনও তা আশীর্বাদ, আবার কখনও তা হয়ে ওঠে অভিশাপের মতো। এ বছর বর্ষা কিছুটা দেরিতে এলেও, তার প্রভাব যেন প্রতিদিনই প্রকট হচ্ছে। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে এসে দক্ষিণবঙ্গ আবারও এক নতুন আবহাওয়াগত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে চলেছে। কারণ, উত্তর বঙ্গোপসাগরের উপর একটি ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হওয়ার পূর্বাভাস মিলেছে। আবহাওয়াবিদদের মতে, আগামী ২৪ ঘন্টার মধ্যে ওই ঘূর্ণাবর্ত নিম্নচাপে রূপান্তরিত হতে পারে, যার প্রভাব সরাসরি পড়বে পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলিতে, বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গ জুড়ে।আবহাওয়া দপ্তরের সূত্রে খবর, বুধবার থেকেই কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গের বহু জেলায় শুরু হয়েছে হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি। সঙ্গে বইছে ৩০ থেকে ৪০ কিলোমিটার গতিবেগের দমকা হাওয়া। তবে মূল নিম্নচাপটি তৈরি হবে বৃহস্পতিবার, এবং তার প্রভাব থাকবে সোমবার পর্যন্ত। এই সময়কালে দক্ষিণবঙ্গের বহু জেলায় ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। বিশেষ করে পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলি, কলকাতা এবং উত্তর ২৪ পরগনায় ব্যাপক বৃষ্টি হতে পারে। এমনকি নদীয়া ও মুর্শিদাবাদেও আংশিক প্রভাব পড়তে পারে।উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রে শুক্রবার থেকে রবিবার পর্যন্ত বিক্ষিপ্তভাবে ভারী বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকছে। দার্জিলিং, কালিম্পং, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি এই সময় প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে পারে। যদিও সোমবার থেকে পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হবে বলে পূর্বাভাস।
আবহাওয়া দপ্তরের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যেই সতর্কতা জারি করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার, ২৪ জুলাই থেকে সমুদ্রে মাছ ধরতে যাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মৎস্যজীবীদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, সমুদ্রের দিকে না যেতে এবং উপকূলবর্তী এলাকায় নিরাপদে থাকতে। রাজ্যের বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তর, পুলিশ প্রশাসন এবং স্থানীয় পঞ্চায়েতগুলিকে সতর্ক করা হয়েছে, যাতে কোনও জরুরি অবস্থায় দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। একই সঙ্গে কলকাতা পুরসভা এবং অন্যান্য মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনগুলিকেও নিকাশি ব্যবস্থার দিকে নজর দিতে বলা হয়েছে, যাতে অতিবৃষ্টির ফলে জলজটের সমস্যা না হয়।দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপ এলাকার এক প্রবীণ মৎস্যজীবী বললেন, “প্রতি বছর এই সময়ে সমুদ্রে না যেতে বললে আমরা রোজগার বন্ধ হয়ে যাই। কিন্তু জান বাঁচানো আগে, তাই আমরা এবারও বাড়িতেই থাকব।” কলকাতার গড়িয়াহাটের এক দোকানদার জানালেন, “বৃষ্টি হলে তো বিক্রি কমে যায়। গত দু’দিন ধরেই ক্রেতা কম, আর যদি এইভাবে বৃষ্টি চলতেই থাকে, তাহলে ব্যবসা মন্দা হবে নিশ্চিত।” অন্যদিকে বেহালার এক অটোচালক বললেন, “সড়কে জল জমলে আমাদের খুব সমস্যা হয়। রাস্তায় গাড়ি চালানো দায় হয়ে পড়ে। আমাদের দাবি, পুরসভা আগে থেকেই ব্যবস্থা নিক।”

আবহাওয়াগত এই পরিবর্তন মূলত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর সক্রিয়তার ফল। বঙ্গোপসাগরের উপর নিম্নচাপ তৈরি হওয়া মানেই, সেটি রাজ্যের উপকূলবর্তী অঞ্চলে প্রভাব ফেলবে। প্রতি বছর বর্ষার সময় এমন পরিস্থিতি দেখা যায় ঠিকই, কিন্তু সমস্যা শুরু হয় যখন একটানা ভারী বৃষ্টি হয়। তখন নদী ফুলেফেঁপে ওঠে, গ্রামীণ এলাকায় জল ঢুকে যায়, কৃষির ক্ষতি হয় এবং শহরাঞ্চলে দেখা দেয় জলজট। এছাড়াও মৎস্যজীবীদের নিরাপত্তা, স্কুল-কলেজ বন্ধ হওয়া, পরিবহণ ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়া—সবই এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের অঙ্গ। গত কয়েক বছরে দেখা গেছে, এই ধরনের নিম্নচাপ প্রায়শই ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত না হলেও প্রবল বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে ব্যাপক ক্ষতি করে যেতে পারে।আপাতত বৃহস্পতিবার থেকে সোমবার পর্যন্ত দক্ষিণবঙ্গে ভারী বৃষ্টি চলবে। তার মাঝে কোথাও কোথাও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতে পারে, গাছ পড়ে রাস্তা বন্ধ হওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। তাই প্রশাসন ও নাগরিকদের যৌথভাবে সতর্ক থাকতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী চিন্তা করলে, এই পরিস্থিতি জলবায়ু পরিবর্তনেরও ইঙ্গিত দিচ্ছে। আবহাওয়াবিদদের মতে, বঙ্গোপসাগরের উষ্ণতা গত কয়েক বছরে বেড়ে যাওয়ায় নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রবণতাও বেড়েছে। তাই রাজ্যের উচিত একে আর শুধুমাত্র মৌসুমী বৃষ্টি হিসেবে না দেখে, একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রাকৃতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে ভাবা।আবারও এক বর্ষার চিহ্ন দক্ষিণবঙ্গে প্রকট হচ্ছে। গাঙ্গেয় অঞ্চলে নিম্নচাপ ও তার জেরে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস নিয়ে সাধারণ মানুষ যেমন চিন্তিত, তেমনি প্রশাসনের ওপর দায়িত্ব বেড়েছে। তবে সময়মতো সতর্কতা, সরকারি উদ্যোগ, এবং জনগণের সচেতনতা থাকলে অনেক বড় ক্ষতি এড়ানো সম্ভব। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে থামানো না গেলেও, তার প্রভাব হ্রাস করা যায় প্রস্তুতির মাধ্যমে। এবারের বৃষ্টি কতটা “আশীর্বাদ” আর কতটা “অভিশাপ” হয়ে দাঁড়ায়, তার উত্তর সময়ই দেবে।