License Fair 2025 organized by Sundarbans District Police:-সকালের নরম রোদ মাথায় নিয়ে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষরা ভিড় জমিয়েছিলেন স্বাগত থানার ময়দানে—সকলে একটাই উদ্দেশ্যে, ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন ও সচেতনতার বার্তা পেতে। শনিবার সকাল ১০টা থেকে শুরু হওয়া এই “লাইসেন্স মেলা ২০২৫”-এর আয়োজন করেছিল সুন্দরবন জেলা পুলিশ, কাকদ্বীপ আঞ্চলিক পরিবহন অফিসের সহযোগিতায়। সাগর থানার ওসি অর্পণ নায়েক-এর উদ্যোগ ও নেতৃত্বে মেলাটি সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন হয়। এই মেলায় প্রায় ১০০ জন মোটরসাইকেল চালককে লার্নার লাইসেন্সের কাগজ হাতে তুলে দেওয়া হয়, যা শুধু তাদের ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়ায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ নয়, বরং সচেতনতার দিক থেকেও এক বড় মাইলফলক।অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী বঙ্কিমচন্দ্র হাজরা, যিনি লাইসেন্স মেলার উদ্বোধন করে বলেন, “সড়ক দুর্ঘটনার খবর আমাদের প্রতিদিন শুনতে হয়। বেশিরভাগ দুর্ঘটনার মূল কারণ লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানো। আজকের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়, কারণ সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলতে এরকম মেলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।” তাঁর কথায় উঠে আসে সরকারের পক্ষ থেকে মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে দায়বদ্ধতার বার্তা।

প্রসঙ্গত, সুন্দরবন এলাকা বরাবরই যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কিছুটা পিছিয়ে। নদী, খাল, বনপথ পেরিয়ে মানুষদের রাস্তায় বের হতে হয়, আর সেখানে অনেকেই নিয়ম কানুন না জেনে বা আইন অমান্য করে মোটরসাইকেল চালান। ফলে প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও ছোট বা বড় দুর্ঘটনা ঘটে, যার ফলে প্রায়শই প্রাণহানি হয়। আর এসব দুর্ঘটনায় জড়িয়ে পড়া মানুষেরা লাইসেন্স না থাকার কারণে সরকারি ক্ষতিপূরণ, ইনস্যুরেন্স, বা চিকিৎসা সংক্রান্ত সাহায্যও পান না। এই প্রসঙ্গে জেলা পরিষদের সদস্য সন্দীপ কুমার পাত্র বলেন, “আজকের এই লাইসেন্স মেলা মানুষকে আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসার প্রথম পদক্ষেপ। যদি আমরা প্রত্যেককে নিয়ম মেনে গাড়ি চালাতে উৎসাহিত করতে পারি, তাহলে দুর্ঘটনা অনেক কমবে।”মেলার মাঠে লাইনে দাঁড়ানো এক তরুণ মোটরসাইকেল চালক রবীন্দ্র সরদার জানালেন, “আমরা এতদিন ভয়ে ভয়ে গাড়ি চালাতাম। পুলিশের চেকিং হলে দৌড় দিতাম। আজ লাইসেন্স পেয়ে মনে হচ্ছে, আমরা আসলে দেশের নাগরিক। এখন থেকে নিয়ম মেনে চলব।” আরেকজন, মালতি মণ্ডল, যিনি তাঁর ছেলের লাইসেন্স করাতে এসেছেন, বললেন, “ছেলে খুব ইচ্ছে করে বাইক চালায়, কিন্তু কখনও সাহস হয়নি লাইসেন্স করতে। এতদূর যেতে হবে, কাগজপত্রের ঝামেলা—সবকিছু ভেবে থেমে যেতাম। আজ এখানে এসে লাইসেন্স করতে পেরে খুব ভালো লাগছে।”
এই মেলার মাধ্যমে শুধু লাইসেন্সের কাগজ দেওয়া নয়, ট্রাফিক নিয়ম, হেলমেট ব্যবহারের গুরুত্ব, ওভারলোডিং না করা, সঠিকভাবে সিগন্যাল মানা—এই সমস্ত বিষয়ে একটি সচেতনতামূলক সেশনও হয়। পুলিশ আধিকারিকরা হাতে-কলমে দেখিয়েছেন কিভাবে ট্রাফিক নিয়ম মানতে হবে। শিশু-কিশোররাও মায়ের হাত ধরে মেলায় এসে দেখেছে কিভাবে লাইসেন্স পাওয়া যায়, আর সেটাও একধরনের শিক্ষা।সাগর থানার ওসি অর্পণ নায়েক বলেন, “আমরা চাই, সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রামগুলির মানুষরাও ট্রাফিক নিয়ম মেনে গাড়ি চালান। লাইসেন্স মেলার মাধ্যমে আমরা মানুষকে সচেতন করতে চাই, যাতে দুর্ঘটনা কমে এবং জীবনের মূল্য রক্ষিত হয়। আমরা ধন্যবাদ জানাই কাকদ্বীপের আরটিও অফিসকে, যাঁরা আমাদের এই উদ্যোগে পাশে থেকেছেন।”

প্রশাসনের এই প্রচেষ্টার ফলে অনেকেই স্বপ্ন দেখছেন, ভবিষ্যতে আর লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানোর প্রবণতা থাকবে না। স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে, এরকম লাইসেন্স মেলা সুন্দরবন পুলিশের অন্যান্য থানাতেও করার পরিকল্পনা রয়েছে।এই ধরনের উদ্যোগ শুধু একটি লাইসেন্স মেলাতেই সীমাবদ্ধ নয়, এর মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষের মধ্যে আইন মেনে চলার সংস্কৃতি গড়ে তোলা, সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দেওয়া, এবং অভ্যন্তরীণ সড়ক পরিবহনের নিরাপত্তা বাড়ানো—এই বৃহত্তর লক্ষ্যগুলিকে ছুঁতে চাইছে সুন্দরবন জেলা পুলিশ।মেলার শেষে মন্ত্রী বঙ্কিমচন্দ্র হাজরা বলেন, “যতদিন না সুন্দরবনের প্রতিটি মানুষ সচেতন না হয়, ততদিন আমাদের এই উদ্যোগ চলবে। এই মেলা শুধু লাইসেন্স দেওয়ার অনুষ্ঠান নয়, এটি এক সচেতনতার উৎসব।” তাঁর কথায়, “সরকারের পক্ষ থেকে মানুষকে সুবিধা দিতে আমরা সদা প্রস্তুত, মানুষকে নিয়ম মেনে চলার জন্য আমরা পাশে আছি।”সব মিলিয়ে বলা যায়, লাইসেন্স মেলা ২০২৫ শুধু একদিনের উদ্যোগ নয়, এটি সুন্দরবন জেলার জন্য এক নতুন দিগন্তের সূচনা। যেখানে প্রতিটি মানুষ নিজের অধিকার জানবেন, নিয়ম মেনে গাড়ি চালাবেন, আর জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। লাইসেন্স থাকা মানে শুধু কাগজের কাগজ নয়, এটি একজন নাগরিকের দায়িত্বের প্রতীক—সেই বার্তাই ছড়িয়ে দিল এই মেলা।