Leopard caught in Dalgaon tea garden : আজকের সকালে ডুয়ার্সের ফালাকাটা ব্লকের দলগাঁও চা বাগান যেন হঠাৎ করেই রুদ্ধশ্বাস এক সিনেমার সেটে পরিণত হয়েছিল—আর সেই সিনেমার মুখ্য চরিত্র ছিল একটি চিতাবাঘ। সকালবেলা, বাগানের নিয়মিত কাজ শুরু হওয়ার আগেই হঠাৎ বনদপ্তরের পাতানো খাঁচা থেকে গর্জনের আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ান স্থানীয় চা শ্রমিকরা। গর্জনের শব্দ যে কেবল গা শিউরে দেওয়ার মতোই ছিল না, তার সঙ্গে ছিল আতঙ্ক, উত্তেজনা আর একরাশ কৌতূহল। যেই না খবর ছড়ালো, মুহূর্তে ছুটে আসেন আশপাশের গ্রামবাসী, চা বাগানের কর্মীরা, এমনকি কাছাকাছি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরাও। যে চিতাবাঘটি এতদিন চা বাগানের বাসিন্দাদের রাতে ঘুমোতে দিচ্ছিল না, শিশুদের স্কুলে যেতে আতঙ্কিত করে তুলছিল, সে আজ খাঁচার ভিতর! বনের চৌকস কর্মীদের তৈরি ফাঁদে শেষমেশ ধরা পড়ে গেল সেই অদৃশ্য আতঙ্কের উৎস। জানা যাচ্ছে, গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই দলগাঁও চা বাগান ও তার আশপাশে চিতাবাঘের চলাফেরার চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল। কখনও রাতের বেলা বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া, কখনও মোষ বা ছাগলকে তুলে নিয়ে যাওয়া—এইসব ঘটনা বারবার স্থানীয় বাসিন্দাদের মনে তীব্র আতঙ্ক তৈরি করছিল। যদিও কেউ চিতাবাঘটিকে সামনে থেকে দেখেননি, তার পায়ের ছাপ, গর্জনের শব্দ এবং প্রাণীর নিখোঁজ হওয়া স্পষ্ট করে দিয়েছিল—এক বিপজ্জনক হিংস্র জন্তু লোকালয়ের খুব কাছেই ঘোরাফেরা করছে।

বনদপ্তরের আলিপুরদুয়ার শাখা, যারা এর আগেও বহুবার চা বাগান সংলগ্ন এলাকায় চিতাবাঘ ধরার কাজে নিযুক্ত হয়েছে, তারা বিশেষজ্ঞ দল পাঠান। কয়েকদিন ধরে পর্যবেক্ষণ, লোকাল গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলা এবং GPS লোকেশন বিশ্লেষণ করে ঠিক করা হয় চা বাগানের কোন অঞ্চলে ফাঁদ পাততে হবে। অবশেষে, মঙ্গলবার সেই খাঁচায় ধরা পড়ে যায় চিতাবাঘটি। বনদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এটি একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ চিতাবাঘ, প্রায় ৫-৬ বছর বয়সী। আজ সকাল ৯টা নাগাদ তার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী চিতাবাঘটি সুস্থ, শরীরে কোনও গুরুতর আঘাত নেই, ওর শরীরের ওজন ও গতিবিধিও স্বাভাবিক রয়েছে। বনকর্মী রবীন ওরাও বলেন, “এই চিতাবাঘটা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চা বাগান সংলগ্ন এলাকায় ঘোরাঘুরি করছিল। অনেকের ছাগল, হাঁস-মুরগি তুলে নিয়ে গিয়েছে। আমরা খবর পাওয়ার পর থেকেই খাঁচা পাতার কাজ শুরু করেছিলাম। আজ অবশেষে সফল হলাম।” অন্যদিকে, দলগাঁও চা বাগানের সুপারভাইজার প্রভাত রায় জানান, “আমাদের শ্রমিকদের মধ্যে কয়েকদিন ধরেই একটা চাপা ভয় কাজ করছিল। কেউ সন্ধ্যার পর বেরোতে চাইতো না, শিশুরা স্কুলে যেতে চাইতো না। আজকে চিতাবাঘ ধরা পড়ায় সবাই অনেকটা নিশ্চিন্ত। তবে আমরা চাই বনদপ্তর এখানেই যেন থেমে না যায়, এমন ঘটনা যাতে আবার না ঘটে তার ব্যবস্থা নেওয়া হোক।” চা বাগানে কর্মরত রমিলা বর্মন বলেন, “গত সপ্তাহে আমার প্রতিবেশীর ছাগল হঠাৎ করে হারিয়ে যায়। আমরা ভেবেছিলাম চুরি হয়েছে, পরে পায়ের ছাপ দেখে বুঝি বাঘ ছিল। আজ সেই বাঘ ধরা পড়েছে দেখে বুকটা হালকা লাগছে। কিন্তু আবার যদি আসে?” স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান গৌতম সরকার বলেন, “এই ধরনের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে ডুয়ার্সের চা বাগানগুলোতে। আমরা বনদপ্তরকে অনুরোধ করেছি আরও নজরদারি বাড়াতে, ক্যামেরা বসাতে। চা বাগান এলাকায় যেহেতু জঙ্গল ঘেঁষে মানুষের বসতি, তাই পশুরা খাবারের খোঁজে লোকালয়ে চলে আসে।
এ বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদি সমাধান দরকার।” এই ঘটনায় আরও একবার পরিষ্কার হল যে, বনাঞ্চলের কাছাকাছি থাকা লোকালয়গুলোতে বন্যপ্রাণীর উপস্থিতি নতুন কিছু নয়। মানুষ ও বন্যপ্রাণীর সংঘাত দিন দিন বেড়েই চলেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বনাঞ্চলে খাবারের অভাব, জলবায়ু পরিবর্তন এবং মানব সম্প্রসারণের ফলে বন্যপ্রাণীরা বাধ্য হয়ে লোকালয়ে চলে আসছে। দলগাঁও চা বাগানে ধরা পড়া চিতাবাঘটির মতো বহু বাঘ বা চিতা প্রায়ই ঘরবাড়ির কাছে চলে আসে, পোষ্য বা গৃহপালিত পশুকে শিকার করে। এ বিষয়ে বনদপ্তরের আধিকারিক মনোজ পাল বলেন, “এই বাঘটি সম্ভবত নিজের এলাকা থেকে সরে এসে চা বাগান এলাকায় ঘোরাফেরা করছিল। তাকে পুনরায় জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হবে, তবে তার উপর নজরদারি রাখা হবে যাতে সে আবার লোকালয়ে না আসে।” স্থানীয়দের মধ্যে বনদপ্তরের কাজের প্রতি কৃতজ্ঞতা থাকলেও অনেকেই জানিয়েছেন তারা চান যেন ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি আর না হয়। বনদপ্তর সূত্রে আরও জানা গেছে, চিতাবাঘটি আগামীকাল আলিপুরদুয়ারের বক্সা জঙ্গলের গভীর অঞ্চলে ছেড়ে দেওয়া হবে। তবে এর আগেও বহুবার দেখা গেছে, এমন ছাড়া চিতাবাঘ আবার ফিরে এসেছে লোকালয়ে। তাই এই ঘটনার পরেও একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে—শুধু ফাঁদ পেতে ধরা নয়, বন্যপ্রাণ ও মানুষের মধ্যে সংঘর্ষের মূল কারণ খুঁজে না পেলে কি আদৌ সমাধান সম্ভব? আপাতত দলগাঁও চা বাগান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেও সামনে ভবিষ্যতের চিন্তা থেকেই যাচ্ছে। তবে এই ঘটনার পরে স্থানীয় স্কুলগুলোতে বনদপ্তর থেকে সচেতনতামূলক কর্মসূচি করা হচ্ছে, যেখানে শিশুদের শেখানো হচ্ছে কীভাবে বনাঞ্চলের পাশে থাকা নিরাপদ আচরণ গড়ে তুলতে হয়। এভাবেই মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থান যদি সঠিকভাবে গড়ে তোলা যায়, তবেই এই সংঘাত কমে আসবে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদেরা। ধরা পড়া চিতাবাঘটি যেন একটা বার্তা—জঙ্গলের অধিকার ও লোকালয়ের নিরাপত্তা, দুটোকেই রক্ষা করতে হবে সমান গুরুত্ব দিয়ে।