Landslides nationwide on Bengal-Sikkim border, communication disrupted:-মঙ্গলবার রাতে হঠাৎ প্রবল বর্ষণে পাহাড় কেঁপে উঠল, ধসে পড়ল বাংলা-সিকিম সংযোগকারী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় সড়ক ১০-এর একাধিক অংশ, যার জেরে সম্পূর্ণভাবে থমকে গেল দুই রাজ্যের মধ্যে যাতায়াতের রাস্তাঘাট ও জীবনধারা। বিশেষ করে তারখোলা ও লিখুভির সংলগ্ন অঞ্চলে ভয়াবহ ধস নামায় পুরো জাতীয় সড়কই মাটির তলায় চলে যায়। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, রাত দশটা নাগাদ হঠাৎ বিকট শব্দে পাহাড়ি অংশ ভেঙে পড়তে শুরু করে, আর মুহূর্তের মধ্যেই রাস্তার উপর জমে ওঠে পাথর, কাদা আর গাছপালা। এমনকি কিছু জায়গায় ধস এতটাই গভীর হয়েছে যে পায়ে হেঁটে যাওয়ার মতো ফাঁকাও নেই। এনএইচ-১০ হলো সিকিমের একমাত্র প্রধান জীবনরেখা, যা শিলিগুড়ির মাধ্যমে গোটা ভারতবর্ষের সঙ্গে এই পাহাড়ি রাজ্যকে যুক্ত করে। ফলে এই রাস্তায় ধস নামা মানেই পুরো সিকিম কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া।

ইতিমধ্যেই ধসে আটকে পড়েছেন বহু পর্যটক, স্থানীয় মানুষ ও পণ্যবাহী গাড়ির চালকরা। একদিকে সিকিম যাওয়ার পথে আটকে রয়েছেন অসংখ্য পর্যটক, অন্যদিকে বাংলার দিকে নামার চেষ্টায় থাকা অনেকেই পাহাড়ে রাস্তায় বসে দিন কাটাচ্ছেন। ধসের পরে দুর্গতদের উদ্ধারে তৎপর হয়েছে প্রশাসন ও বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী, যারা রাতের অন্ধকারেই উদ্ধারকাজ শুরু করে দেয়। পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং প্রশাসনের এক আধিকারিক বলেন, “ধসের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা বিপর্যয় মোকাবিলা দল পাঠিয়েছি। প্রাথমিকভাবে বড় গাড়িগুলিকে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং আটকে পড়া মানুষদের নিরাপদ জায়গায় নিয়ে আসার কাজ চলছে।” সিকিম প্রশাসনের তরফ থেকেও জানানো হয়েছে, রাস্তাঘাট যত দ্রুত সম্ভব পরিষ্কার করে পুনরায় যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করার চেষ্টা চলছে। ইতিমধ্যেই লিখুভির ধস কবলিত এলাকায় একাধিক জেসিবি এবং বুলডোজার নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রবল বৃষ্টিতে মাটি আলগা হয়ে গিয়ে যে ধস নামছে, তা নিয়ে পরিবেশবিদরাও চিন্তিত। তাঁদের মতে, লাগাতার অযথা রাস্তা চওড়া করা, পাহাড় কাটাকাটি, অপরিকল্পিত নির্মাণ—এই সবকিছু মিলেই আজকের এই বিপর্যয়ের মূল কারণ। স্থানীয় বাসিন্দা বিমল রাই বলেন, “প্রতিবার বর্ষা এলেই এই রাস্তায় ধস নামে। কিন্তু কেউ স্থায়ী সমাধানের চেষ্টা করে না। শুধু মাটি সরিয়ে গাড়ি চালানোর রাস্তা করে দেওয়াই এখনকার রেওয়াজ।” ধসে আটকে পড়া একজন পর্যটক, কলকাতার বাসিন্দা অর্চনা বসাক জানিয়েছেন,
“আমরা তিনদিন আগে গ্যাংটক গিয়েছিলাম। ফেরার পথে জানতে পারি রাস্তায় ধস নেমেছে। এখন পাহাড়ে একটি ছোট দোকানে বসে আছি। খাওয়া-দাওয়া, থাকার কিছুই নেই। ফোনের নেটওয়ার্কও কাজ করছে না। খুবই ভয় লাগছে।” এই ধসের জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খাদ্য সরবরাহ থেকে শুরু করে জরুরি পরিষেবা পর্যন্ত। সিকিমে পৌঁছাতে পারছে না ওষুধ, খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি। এমনকি পাহাড়ে থাকা রোগীদের চিকিৎসার জন্য শিলিগুড়ি বা অন্যান্য বড় শহরে নামিয়ে আনা যাচ্ছে না। চিকিৎসক এবং অ্যাম্বুল্যান্স চালকরাও জানিয়েছেন, এই ধস তাঁদের কাজকে একেবারে স্তব্ধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে রেলপথ না থাকায় এবং হেলিকপ্টার পরিষেবা খুবই সীমিত হওয়ায় এই ধসের সময় সিকিম কার্যত এক ঘরবন্দি রাজ্যে পরিণত হয়েছে। প্রাকৃতিক এই বিপর্যয় সামাল দিতে একদিকে যেমন জোরকদমে উদ্ধারকাজ চলছে, তেমনি সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছে, পাহাড়ে রক্ষণাবেক্ষণ ও নজরদারি আরও বাড়ানো হবে। কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহণ মন্ত্রকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, “এই জাতীয় সড়কটি পুনরুদ্ধারে যত দ্রুত সম্ভব ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যেই BRO এবং এনএইচ ডিপার্টমেন্ট যৌথভাবে কাজ শুরু করেছে।

” তবে প্রশ্ন উঠছে, প্রতি বছর এই ধরনের ধসের ঘটনা ঘটছে জেনেও কেন আগাম সতর্কতা নেওয়া হচ্ছে না? কেন পাহাড়ে চিরস্থায়ী ও শক্তপোক্ত রাস্তাঘাট তৈরি করা হচ্ছে না? উত্তরবঙ্গের পরিবেশকর্মী সুনীতা শর্মা বলেন, “পাহাড়কে কেটে, গাছ কেটে রাস্তাঘাট বানানোর ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। প্রশাসন চাইলে বিকল্প রুট বা সুসংহত পরিকল্পনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করতে পারে। কিন্তু সেটা কেউ করছে না।” ধস কেবল যোগাযোগ ব্যবস্থা থামিয়ে দেয় না, মানুষের মনে দীর্ঘস্থায়ী ভয় ঢুকিয়ে দেয়। যারা প্রতিদিন এই রুটে চলাফেরা করেন, তাঁরা ভাবছেন, পরেরবারও কি এমন বিপদ ঘটতে পারে? নিরাপত্তাহীনতা, দুশ্চিন্তা আর চরম দুর্ভোগ এখন পাহাড়ি মানুষের নিত্যসঙ্গী। এই অবস্থায় প্রশাসনের একটাই করণীয়—এই গুরুত্বপূর্ণ সড়কটিকে যেন শুধুমাত্র ধস ঠেকানো নয়, একে ধসপ্রতিরোধক প্রকল্প হিসেবে গড়ে তোলা হয়। পাশাপাশি স্থানীয় মানুষ, পরিবেশবিদ, পর্যটন বিভাগ, প্রতিরক্ষা দপ্তর—সব পক্ষকে নিয়ে যৌথ আলোচনার মাধ্যমে এমন একটি পরিকল্পনা করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আর এইরকম দুর্ভোগ না হয়। কারণ ধস একদিনের জন্য নয়, বরং প্রত্যেক বর্ষায় ঘুরে ফিরে ফিরে আসে এই বিপদ। তাই সময় থাকতে সতর্ক হওয়াই একমাত্র পথ।