Land dispute, barbed wire work at border halted:উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটা, বসিরহাট, বনগাঁ, হাড়োয়া, স্বরূপনগর—এইসব সীমান্তবর্তী এলাকায় আজও অনেক জায়গায় কাঁটাতার বসেনি। কোথাও আবার বসেছে, কিন্তু বছরের পর বছর ধরে তা পড়ে পড়ে ছেঁড়া, গলাধাক্কা খাচ্ছে বৃষ্টি-রোদে। এই অবস্থায় সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান, অবৈধ অনুপ্রবেশ বা নিরাপত্তা ঘাটতির আশঙ্কা যে বেড়েছে, তা আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। অথচ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ রাজ্যে এসে স্পষ্ট বললেন, “কাঁটাতার না বসার একমাত্র কারণ রাজ্য সরকারের জমিজট সমাধানে অনীহা।” তিনি অভিযোগ করেন, কেন্দ্র বারবার রাজ্যকে জমি চেয়ে আবেদন জানালেও, রাজ্য জমি দিচ্ছে না। তাই সীমান্তে কাঁটাতার বসানো সম্ভব হচ্ছে না। রাজ্য সরকার জমি দিলেই সীমান্তে দ্রুত কাঁটাতারের কাজ শুরু করা হবে, এমনটাই কেন্দ্রের সাফ বার্তা।
অন্যদিকে রাজ্য সরকারের একাংশ বলছে, “কেন্দ্র জমির ন্যায্য ক্ষতিপূরণের পরিকল্পনা বা সঠিক নকশা ছাড়াই প্রকল্পের কাজ শুরু করতে চাইছে। তা আমাদের পক্ষে গ্রহণযোগ্য নয়।” রাজ্যের দাবি, বহু জায়গায় মানুষ নিজের ভিটেমাটি, ফসলের জমি ছেড়ে দিতে নারাজ, কারণ তারা পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ পাচ্ছে না। রাজ্যের আরও বক্তব্য, সীমান্ত এলাকার মানুষদের মধ্যে গার্ডওয়াল বা কাঁটাতারের অবস্থান নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। কেউ কেউ চান না, তাদের ঘরের সামনে দণ্ডায়মান হয়ে থাকুক সীমান্ত, আবার কেউ কেউ চাইছেন নিরাপত্তার খাতিরে যত শীঘ্র সম্ভব তার বসুক।
এই অবস্থায় গাইঘাটার অন্তত তিনটি গ্রামের পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত। সেখানকার এক বাসিন্দা, ৬০ বছরের সন্তোষ মন্ডল বললেন, “বছরের পর বছর ধরে শুনছি এখানে কাঁটাতার বসবে। বিএসএফ আছে বটে, কিন্তু ভয়টা যায় না। রাতে গরু পাচার হয়, মাঝেমধ্যে বোমা পড়ে শুনি। আমরা চাই তার বসুক, জমি চাইলে দেব। নিরাপত্তা আগে।” একই সুর আর এক তরুণ কৃষক শিবু সরকারের গলায়, “আমরা নিজের জমিতে কাজ করি ঠিকই, কিন্তু অনিশ্চয়তা থেকে যায়। চারপাশে যখন পাচার আর অবৈধ প্রবেশের খবর শুনি, তখন আতঙ্ক হয়। সরকার যদি বলে, জমি লাগবে, আমরা রাজি। কিন্তু কাজ তো শুরু হোক!”
আসলে সীমান্তে কাঁটাতার বসানো কেবল কাগজে কলমে নিরাপত্তা নয়, বাস্তবে অনেককিছু বদলে দেয়। যেমন ধরা যাক একজন কৃষকের ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে সীমান্ত রোড গেলে বা তার লাগোয়া কাঁটাতার বসলে, সে তখন আর তার জমিতে আগের মত চাষ করতে পারে না। এমনকি যদি তার ঘর কাঁটাতারের বাইরে পড়ে, তবে বিএসএফের অনুমতি ছাড়া সে ঘরে ঢুকতেও পারবে না। এই বাস্তবতা অনেকের পক্ষে কঠিন। অথচ এসবেরই সমাধান সম্ভব ছিল যৌথ উদ্যোগে, যদি কেন্দ্র-রাজ্য মুখোমুখি না হয়ে একসাথে কাজ করত।
প্রসঙ্গত, বর্তমানে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে প্রায় ৪ হাজার কিলোমিটারেরও বেশি সীমান্ত রয়েছে, যার মধ্যে বাংলার ভাগ ২,২১৭ কিমি। সেই বিশাল সীমান্তের বহু অংশেই এখনও কাঁটাতার বসেনি বা বহু পুরনো হয়ে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতি দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় ফাঁক তৈরি করছে। সীমান্ত নিরাপত্তা বিশারদ কর্নেল (অব.) অরূপ রায়চৌধুরী জানিয়েছেন, “যতক্ষণ না সীমান্ত পুরোপুরি সিল করা যায়, ততদিন পাচার, অনুপ্রবেশ বা সীমান্ত সন্ত্রাস ঠেকানো সম্ভব নয়। কিন্তু সেটা করতে গেলে কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের মধ্যে সমন্বয় প্রয়োজন।”
কেন্দ্রীয় সরকার যদিও বলছে যে প্রকল্পের অর্থ, প্রযুক্তি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা সবই তৈরি, শুধু জমির ওপরই থমকে কাজ। তবে রাজনৈতিক মহল বলছে, এই জমিজটের পেছনে শুধু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা নয়, আছে রাজ্য ও কেন্দ্রের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী টানাপোড়েনও। কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যকে দায়ী করলে, রাজ্যও দোষ চাপাচ্ছে কেন্দ্রীয় নীতির ওপর। আর এই দড়ি টানাটানিতে পড়ে থাকছে সাধারণ মানুষ, যারা প্রতিদিন সীমান্তের পাশ দিয়ে চলাফেরা করেন, চাষবাস করেন, সন্তানদের স্কুলে পাঠান—এবং প্রতিনিয়ত আতঙ্কে থাকেন।
বিশেষ করে উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগর এলাকায় চোরাকারবারিদের দাপট, গরু পাচার, ফেন্সিং না থাকা এলাকা দিয়ে অনুপ্রবেশের ঘটনা ইদানিং বেড়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসনেরই অভ্যন্তরীণ রিপোর্টে উঠে এসেছে। সীমান্তবর্তী এক মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক কৃষ্ণেন্দু সর্দার জানালেন, “সকালে স্কুলে আসার পথে প্রায়ই দেখি বিএসএফ কাউকে তাড়া করছে বা আটক করেছে। অনেক সময় ছাত্রদের অভিভাবকরা ভয় পান তাদের ছেলেমেয়েদের একা স্কুলে পাঠাতে। এই পরিস্থিতি বদলাতে হলে কাঁটাতার জরুরি।”
এইরকম পরিস্থিতিতে আগামী দিনে কি সমাধান হবে? এই প্রশ্নের উত্তর আপাতত ধোঁয়াশাতেই ঢাকা। কেন্দ্রীয় সরকার জমি না পাওয়ার অভিযোগ চালিয়ে যাবে, রাজ্য সরকারেরও আপত্তির তালিকা থাকবে। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এই টানাপোড়েন যতদিন চলবে, ততদিন সীমান্তের সাধারণ মানুষ অনিরাপদই থেকে যাবেন। তাই এখন সময়, রাজনীতি নয়, মানবিকতা ও নিরাপত্তার প্রশ্নে দ্রুত সমঝোতার।