Krish and Kishore fulfill their father’s unfulfilled dream:বয়স মাত্র আট বছর, কিন্তু গলায় যেন সুরের যাদু নিয়ে জন্মেছে কৃষ মন্ডল। তার ভাই কিশোর মন্ডলের সঙ্গে গাওয়া গানের প্রতিটি লাইন যেন আবেগ ছুঁয়ে যায় হাজারো মানুষের হৃদয়। আর ঠিক সেই কারণেই আজ সামাজিক মাধ্যম জুড়ে ভাইরাল উত্তর ২৪ পরগনার সীমান্ত শহর বনগাঁর এই দুই ভাই। তারা কেবল গান গাইছে না, তারা এক অসম্পূর্ণ স্বপ্নের ধারক ও বাহক। তাদের বাবা বিদুষ মন্ডলের ছোটবেলার স্বপ্ন ছিল সংগীতশিল্পী হওয়ার। কিন্তু জীবনের বাস্তবতা, দারিদ্র্য আর সীমিত সুযোগের কারণে সেই স্বপ্ন কখনও বাস্তবের আলো দেখেনি। তবে বাবা নিজের ছেলেদের চোখে সেই স্বপ্নের আলো দেখতে চেয়েছিলেন, আর আজ সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিচ্ছে কৃষ ও কিশোর।
কৃষ মন্ডল মাত্র আট বছরের, কিন্তু তার গলায় যে পরিণত সুর আর আবেগ ভরা গায়কী, তা শুনে বহু সংগীতপ্রেমীই বিস্ময়ে বলছেন—“এই বয়সে এরকম কণ্ঠস্বর, এটা অলৌকিক!” কিশোরের বয়স একটু বড়, সে কৃষের দাদা এবং গানের প্রথম গাইডও বলা চলে। বাবা বিদুষ মন্ডল স্বপ্ন পূরণ না করতে পারলেও, পরিবারের প্রতিটি দিন কেটেছে গানের মধ্যেই। সকাল হলেই দুই ভাই বাবার সামনে বসে রেওয়াজ শুরু করে, রিয়াজ হয় কখনও হারমোনিয়াম নিয়ে, কখনও খালি গলায়। তাদের মা ঝর্ণা মন্ডল জানান, “ওদের বাবা বলতেন, আমি তো পারিনি, কিন্তু আমার ছেলেরা যদি গান গাইতে পারে, তাহলে আমি নিজেকে সফল ভাবব।” বাবার সেই কথা আজ যেন বাস্তবে ধরা দিচ্ছে।সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে কৃষ জনপ্রিয় হিন্দি গান গেয়েছে সুরের অপূর্ব আবেগে, আর ভাই কিশোর তানপুরা ও তালের মাধ্যমে সহযোগিতা করেছে। ভিডিওটি নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে আগুনের মতো। কমেন্ট বক্স ভরে গেছে ভালোবাসা, শুভেচ্ছা আর প্রশংসার বন্যায়। কেউ লিখছেন, “এই ছেলেটিকে সঠিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হোক, ভবিষ্যতে এ অনেক দূর যাবে।” কেউ বলছেন, “এ যেন বাংলার শ্রেয়া ঘোষাল বা অরিজিৎ সিংয়ের ভবিষ্যৎ রূপ।” দুই ভাইয়ের গানের জন্য এখন বনগাঁয় এক ধরনের উৎসবের আবহ। প্রতিবেশীরা সকালবেলা দাঁড়িয়ে শোনেন দুই ভাইয়ের রেওয়াজ, দোকানে কৃষ-কিশোরের ভিডিও চালিয়ে দেন মানুষজন, এমনকি স্থানীয় স্কুলের শিক্ষকরাও গর্বিত যে এমন প্রতিভাবান ছাত্র তাদের বিদ্যালয়ের গর্ব। স্কুলশিক্ষক শুভ্রা দে জানালেন, “আমি কৃষকে ক্লাসে দেখেছি। খুবই শান্ত ও মনোযোগী। কিন্তু যখন গান গায়, তখন মনে হয় ও যেন এক ভিন্ন জগতের বাসিন্দা।”তবে এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের যাত্রা একেবারেই সহজ নয়। পরিবারটি আর্থিকভাবে খুব বেশি স্বচ্ছল নয়। বিদুষ বাবু একজন ছোট কাজের মানুষ ছিলেন, এখন শরীর ভালো না থাকায় বাড়িতেই থাকেন। মায়েরই এখন সংসার চালানোর প্রধান দায়িত্ব। তবুও সংগীতচর্চার পথ আটকে যায়নি। পাশের পাড়ার এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক হরমোনিয়াম কিনে দিয়েছেন নিজেদের টাকায়, আর স্থানীয় এক কলেজ পড়ুয়া ছাত্র কিশোরদের ইউটিউব অ্যাকাউন্ট খুলে ভিডিও আপলোডে সাহায্য করছে।বর্তমানে কৃষ ও কিশোরের গানের ভিডিও দেখে বহু সংগীত প্রতিষ্ঠান তাদের প্রশিক্ষণের প্রস্তাব দিয়েছে, এমনকি কলকাতার এক নামী সংগীত সংস্থাও যোগাযোগ করেছে বলে জানান মা ঝর্ণা মন্ডল। তিনি বলেন, “আমরা চাই ওরা যেন ঠিকমতো শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে, বাবার স্বপ্নটা যেন সত্যি হয়। তবে আমরা চাই কেউ যেন তাদের দিয়ে কোনওভাবে বাণিজ্য না করে।”
তবে প্রশ্ন উঠছে—এই প্রতিভা যদি সঠিকভাবে লালন-পালন না হয়, তাহলে কি এত দূর গিয়ে থেমে যাবে না তাদের পথ? সংগীত বিশারদ অর্ণব চক্রবর্তী বলেন, “এই বয়সের প্রতিভাকে সবচেয়ে বেশি দরকার সংবেদনশীল প্রশিক্ষণ। যদি ঠিক লোকের হাতে ওরা পৌঁছায়, তাহলে সত্যিই বাংলার গর্ব হয়ে উঠবে কৃষ ও কিশোর।” তিনি আরও বলেন, “তাদের গায়কী একেবারে প্রাকৃতিক, এই জাতীয় কণ্ঠস্বর তৈরি হয় না—জন্মগত গুণ।”এই প্রতিভার খবর ইতিমধ্যেই জেলা প্রশাসনের কানেও পৌঁছেছে। জেলা সাংস্কৃতিক আধিকারিক অরিন্দম বসু জানিয়েছেন, “আমরা বিষয়টি নজরে রেখেছি। জেলা স্তরে শিশু প্রতিভাদের নিয়ে একটি বিশেষ উৎসবের ভাবনা চলছে। সেখানে কৃষ ও কিশোরকে ডাকা হবে। পাশাপাশি, রাজ্য শিশু কল্যাণ দপ্তরকেও জানানো হয়েছে।”এই দুই ভাইয়ের গানে শুধু গলা বা সুর নয়, মিশে আছে একটা অদ্ভুত আবেগ—একজন বাবার না-পাওয়ার কষ্ট, এক সন্তানের সেই কষ্টকে গানে পূরণ করার জেদ। এই জেদ, এই সাধনাই একদিন বাংলার মাটিকে গর্বিত করে তুলবে বলেই মনে করছে বনগাঁবাসী। আজ যেখানে সোশ্যাল মিডিয়া শুধু চটকদার কনটেন্টে ভরা, সেখানে কৃষ ও কিশোরের গান যেন একখণ্ড নির্মল শান্তি, এক শিশিরস্নাত স্বপ্ন।