Wednesday, July 9, 2025
Google search engine
Homeটপ 10 নিউসসরকার বিরোধী আন্দোলনে অগ্নিগর্ভ কেনিয়া

সরকার বিরোধী আন্দোলনে অগ্নিগর্ভ কেনিয়া

Kenya on fire with anti-government protests : ৭ জুলাই, যেটা কেনিয়ার ইতিহাসে গণতন্ত্রের লড়াইয়ের এক স্মরণীয় দিন, সেই দিনটি এবছর পরিণত হলো এক ভয়ংকর রক্তাক্ত অধ্যায়ে। প্রেসিডেন্ট উইলিয়াম রুটোর নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে যখন হাজার হাজার সাধারণ মানুষ রাস্তায় নামলেন, তখন রাজধানী নাইরোবিসহ গোটা কেনিয়াজুড়ে যেন আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এই দিনটি মূলত ১৯৯০ সালের সেই ঐতিহাসিক আন্দোলনের স্মরণে পালন করা হয়, যখন তৎকালীন স্বৈরাচারী প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল আরাপ মোইয়ের বিরুদ্ধে মানুষ বহুদলীয় গণতন্ত্রের দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিলেন। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি যেন সেই ইতিহাসকেও ছাড়িয়ে গেছে। কারণ, এবার আন্দোলনের কেন্দ্রে ছিল নতুন কর আইন, বেকারত্ব, জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয় এবং সরকারি দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, যার বিস্ফোরণ ঘটেছে গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই। “ফিনান্স বিল ২০২৪” নামের নতুন কর কাঠামোতে সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ওপর অতিরিক্ত কর বসানোর প্রস্তাব দিয়েছে, যার প্রতিবাদেই রাস্তায় নেমেছে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম। এই তরুণরাই সোশ্যাল মিডিয়ায় “#RejectFinanceBill2024” হ্যাশট্যাগে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন গেন জেড—তরুণ শিক্ষার্থী, চাকরিপ্রার্থী, ও সাধারণ কর্মজীবী মানুষ, যারা মনে করেন এই বিল তাদের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এক তরুণ আন্দোলনকারী, নাইরোবির বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আন্না কিবেট বলেন, “আমরা শুধু আমাদের ভবিষ্যৎ চাই, কর আর দুর্নীতির বোঝা নয়।

Keniya

সরকার আমাদের কণ্ঠস্বর চেপে দিতে চাইছে, কিন্তু আমরা থামবো না।” গত সোমবার এই প্রতিবাদ চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়, যখন বিক্ষোভকারীরা নাইরোবির কেন্দ্রস্থলে অবস্থান শুরু করেন। পুলিশ দ্রুত রাস্তা অবরোধ করে, কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে এবং পরে গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে। ফলাফল—১১ জন সাধারণ মানুষের মৃত্যু এবং শতাধিক আহত, যাদের মধ্যে অনেকেই তরুণ। বিপরীতে, পুলিশের দাবি অনুযায়ী, সংঘর্ষে অন্তত ৫২ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। কেনিয়ার হিউম্যান রাইটস কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই পদক্ষেপ ছিল অমানবিক ও অপ্রয়োজনীয়ভাবে সহিংস। তারা সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করে এই “নাগরিক হত্যাকাণ্ডের” বিচার নিশ্চিত করতে। জানা গেছে, নিহতদের মধ্যে ১৯ বছর বয়সী একটি ছেলেও রয়েছে, যার নাম পিটার ওকো, যে তার কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে মিলে শুধুমাত্র হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিল।

তার মা মিডিয়ার সামনে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমার ছেলে কোনো দাঙ্গাবাজ ছিল না, সে কেবল ভবিষ্যতের জন্য আওয়াজ তুলেছিল। আজ আমি ছেলে হারালাম, কাল হয়তো আরেক মা হারাবেন।” দেশের বাকি অংশেও এর প্রতিক্রিয়া তীব্র। কিসুমু, এল্ডোরেট, মোমবাসা, এবং নাকুরুতেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন, ছাত্র ইউনিয়ন এবং মানবাধিকার সংস্থা এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। এমনকি কিছু চার্চ ও মসজিদ থেকেও শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়েছে। রাজনীতি বিশ্লেষকদের মতে, প্রেসিডেন্ট রুটোর সরকার এই আন্দোলনের গুরুত্ব না বুঝে যেভাবে দমনমূলক পদক্ষেপ নিচ্ছে, তা আরও গভীর রাজনৈতিক সংকট ডেকে আনতে পারে। আন্তর্জাতিক মহলেও এই আন্দোলন নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা কেনিয়ার সরকারের গুলি চালানোর ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার একটি বিবৃতিতে বলেন, “সরকারের উচিত জনগণের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে শ্রদ্ধা জানানো, না-হলে গণতান্ত্রিক কাঠামো ধ্বংসের মুখে পড়বে।” সোশ্যাল মিডিয়ায় ইতিমধ্যেই গনবিক্ষোভের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে।

kenya anti government protest saba saba day nairobi july 7 2025 20250707183903

অনেকেই তুলনা টেনেছেন অতীতের আরব বসন্ত বা শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটকালীন আন্দোলনের সঙ্গে। কেনিয়ার একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ভাষ্যকার ড. এস্থার ওমন্ডি বলেন, “এই মুহূর্তে সরকার যদি তরুণদের কণ্ঠস্বর না শোনে, তবে আগামী দিনে দেশ এক মারাত্মক সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকে এগিয়ে যাবে।” অন্যদিকে, সরকার দাবি করেছে যে আন্দোলনকারীরা ‘চরমপন্থী’ হয়ে উঠেছেন এবং রাষ্ট্রের সম্পত্তি ধ্বংস করছেন, যার ফলে পুলিশকে বাধ্য হয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। কিন্তু এই দাবি সাধারণ মানুষ মানতে রাজি নয়। কেনিয়ার একজন সাধারণ দোকানদার বলেন, “আমরা জানি আন্দোলনকারীরা শান্তিপূর্ণ ছিল, সরকার শুধু আমাদের মুখ বন্ধ করতে চায়। এখন রুটি কেনার টাকাও নেই, কর বসিয়ে সরকার শুধু আমাদের শ্বাসরোধ করছে।” কেনিয়ার এই পরিস্থিতি শুধু দেশের ভেতরে নয়, আশেপাশের আফ্রিকান দেশগুলোতেও একটা বার্তা পাঠাচ্ছে—যেখানে তরুণ প্রজন্ম আর চুপ করে থাকতে রাজি নয়। তারা গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা চায়। আজ কেনিয়ার যে আগুন জ্বলছে, তা যদি নিভে না যায় আলোচনার মাধ্যমে, তবে সেটা শুধু আর্থিক নয়, রাজনৈতিক বিপর্যয়ও ডেকে আনতে পারে। কেনিয়ার জনগণের এই অগ্নিগর্ভ প্রতিবাদ কেবল সরকারবিরোধী ক্ষোভ নয়, এটি একপ্রকার সামাজিক চেতনার জাগরণ, যা বুঝিয়ে দিচ্ছে—গণতন্ত্র মানে শুধু ভোট নয়, গণতন্ত্র মানে মানুষের কণ্ঠস্বরের মর্যাদা। এখন দেখা যাক, প্রেসিডেন্ট রুটো সেই কণ্ঠ শুনবেন কিনা।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments