Jyoti malhotra: পাহাড়ের শান্ত পরিবেশে যখন পর্যটকরা ছবি তুলতে ব্যস্ত, তখন এক জন ইউটিউবারের ক্যামেরায় ধরা পড়ছে আরও কিছু—এমন কিছু, যা শুধু ট্র্যাভেল ব্লগ নয়, বরং দেশের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করার ছক। হরিয়ানার হিসারের বাসিন্দা ইউটিউবার জ্যোতি মালহোত্রা পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা ISI (Inter-Services Intelligence)-এর হয়ে ভারতে ছদ্মবেশে গোয়েন্দাগিরি চালানোর অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছে। শুধু কাশ্মীর বা হরিয়ানাতেই নয়, তদন্তে উঠে এসেছে জ্যোতির বিস্তৃত সফরনামা—কলকাতা, ব্যারাকপুর, শেওড়াফুলি থেকে শিলিগুড়ি, এমনকি পাহেলগাম, পুরী ও কোনার্ক পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে তার ছায়া। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রাথমিক অনুমান, এই সফর ছিল সম্পূর্ণ পরিকল্পিত, উদ্দেশ্য ছিল ভারতের কৌশলগত এলাকাগুলির গোপন তথ্য সংগ্রহ।
পশ্চিমবঙ্গের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা যেমন শিয়ালদহ স্টেশন, ব্যারাকপুর, এমনকি এক বিরিয়ানি দোকান, যেখানে সে স্বাভাবিক পর্যটক সেজে ভিডিও করে—সব কিছুই এখন গোয়েন্দাদের নজরে। এই ভিডিওগুলি তার ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড হলেও পুলিশের সন্দেহ, ভ্লগের আড়ালে সেনাঘাঁটি, রেলস্টেশন, বিমানঘাঁটি ও জনবহুল এলাকায় নজরদারি চালানোই ছিল তার আসল উদ্দেশ্য। বিশেষ করে ব্যারাকপুরের পুরনো IAF ঘাঁটি, শিলিগুড়ির ৩৩ কর্পস হেডকোয়ার্টার, বাগডোগরা ও হাসিমারার এয়ারফোর্স স্টেশন—এই জায়গাগুলিতে তার উপস্থিতি পরিস্থিতিকে অনেক বেশি গুরুতর করে তুলেছে।

তদন্তে জানা গিয়েছে, সে শেওড়াফুলির একটি বিয়েতে আমন্ত্রিত হয়েছিল। এখন প্রশ্ন উঠছে—কে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল? পরিবারের সঙ্গে তার কী সম্পর্ক ছিল? তদন্তকারীরা সেই পরিবার ও তাদের যোগাযোগ নিয়ে এখন গভীর অনুসন্ধানে ব্যস্ত। শুধু তাই নয়, ভুটান যাওয়ার অজুহাতে সে দিল্লি থেকে বাগডোগরা ফ্লাইটে আসে এবং শিলিগুড়িতে বেশ কিছুদিন কাটায়—যেখানে সে বিভিন্ন বাজার ও স্থানীয় এলাকায় ঘুরে ঘুরে ভিডিও করে।
জম্মু-কাশ্মীরের পাহেলগামে এপ্রিল মাসে সে ঘুরতে যায়। অথচ, একই পাহেলগামে তিন মাস পর ঘটে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা। IB সূত্রে জানা গিয়েছে, জ্যোতি এই সফরের সময় হামলার সম্ভাব্য রুট, সেনা উপস্থিতি, পর্যটক চলাচলের তথ্য ও ভূগোল খুঁটিয়ে দেখে গিয়েছে। তাই সন্দেহ বাড়ছে যে এই সফর শুধুমাত্র ভ্রমণ ছিল না—বরং হামলার আগে তথ্য সংগ্রহের এক বড় পরিকল্পনার অংশ ছিল।
পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, সে পুরী ও কোনার্কেও গিয়েছিল, যেখানে এক স্থানীয় ইউটিউবারের সঙ্গে ভ্রমণ ও মন্দির-পরিদর্শনের ভিডিও করেছে। তবে পুলিশের ধারণা, এই ভিডিও ছিল একটা ছদ্মাবরণ—এর আড়ালে চলছিল ধর্মীয় স্থানের ভূগোল, নিরাপত্তা কাঠামো, জনঘনত্ব সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ। আর এইসব তথ্যই হয়তো সে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থাকে সরবরাহ করেছে।
জ্যোতির বিরুদ্ধে ইতিমধ্যেই অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-এর ৩ ও ৫ নম্বর ধারা, এবং ভারতীয় দণ্ডবিধির ১৫২ নম্বর ধারা অনুযায়ী মামলা দায়ের হয়েছে। তাকে ৫ দিনের পুলিশ হেফাজতে পাঠানো হয়েছে। কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স তদন্তে নেমেছে, এবং তারা হরিয়ানা পুলিশের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য ও ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করছে।
গোয়েন্দাদের মতে, এই গোটা সফরের পেছনে ISI-এর সুপরিকল্পিত ছক রয়েছে। পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা বহুদিন ধরেই ইউটিউব, টিকটক বা ইনস্টাগ্রাম ব্লগারদের মাধ্যমে গোপন তথ্য সংগ্রহে মন দিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে সাধারণ দর্শকের চোখে harmless বা নিরীহ মনে হলেও, এই ধরনের ইউটিউবারদের মাধ্যমেই সেনাঘাঁটি, রেলস্টেশন বা সীমান্তবর্তী এলাকার ছবি ও ভিডিও সহজেই পাচার হচ্ছে।
একজন তদন্তকারী অফিসার জানিয়েছেন, “ভিডিওতে যেটা আমজনতার চোখে সাধারণ ভ্রমণের ছবি, সেটাই আসলে সেনাঘাঁটি, নিরাপত্তা কাঠামো বা গতিবিধির বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরছে। এসব ভিডিও এডিট করে ঠিক যেভাবে ISI-এর কাছে পাঠানো হয়, সেটাই এখন খতিয়ে দেখা হচ্ছে।”
তবে এই ঘটনায় শুধু পুলিশের নয়, দেশের প্রতিটি সাধারণ নাগরিকের সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। কারণ, আজকের দিনে একটি মোবাইল ভিডিও, একটি সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট, একটি ব্লগ—সবই দেশের নিরাপত্তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। জ্যোতির মতো ইউটিউবাররা যদি বাস্তবে গুপ্তচর হয়ে ওঠে, তাহলে গোটা নিরাপত্তা ব্যবস্থাই প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ে।
এই ঘটনার প্রেক্ষিতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রক রাজ্য সরকারগুলিকে সতর্ক করেছে, এবং সমস্ত ভ্লগার বা কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের যাচাই করতে বলা হয়েছে, বিশেষ করে যারা কৌশলগত বা সেনা সংশ্লিষ্ট এলাকায় বারবার ভ্রমণ করে।
সমাপ্তিতে, বলা যায়, জ্যোতি মালহোত্রার এই ঘটনা ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি এক কঠিন সতর্কবার্তা। এখন প্রয়োজন আরও সচেতনতা, প্রযুক্তিগত নজরদারি এবং নাগরিকদের মধ্যে তথ্য-সচেতনতা।