Friday, May 23, 2025
Google search engine
Homeরাজনীতিঅন্যানো রাজনীতিমার খেয়েও রাতভর আন্দোলনে অনড় চাকরিহারারা

মার খেয়েও রাতভর আন্দোলনে অনড় চাকরিহারারা

Jobless workers persist in protest all night despite being beaten :বিকাশ ভবনের সামনে ভোর রাত, ঝিমঝিমে ঠান্ডায় কাঁপছে কলকাতার আকাশ, তবুও অনড় একদল মানুষ! তাঁদের চোখে ঘুম নেই, মুখে ক্লান্তি নেই, বুক ভরা শুধুই একটাই কথা—“চাকরি চাই, প্রাপ্য চাই, ন্যায় চাই!” মার খেয়েও রাতভর মাটি কামড়ে বসে থাকা এই শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীদের প্রতিবাদ যেন এক জীবন্ত ইতিহাস হয়ে উঠেছে। ফের উত্তাল হয়ে উঠল বিকাশ ভবন চত্বর। দফায় দফায় বিক্ষোভ, গেট ভাঙা, পুলিশের লাঠিচার্জ, চোখের জলে ভেসে যাওয়া শিক্ষকদের কান্না—সব মিলিয়ে গতকাল ছিল পশ্চিমবঙ্গের চাকরিহারাদের আন্দোলনের এক নতুন অধ্যায়।

গল্পটা শুরু হয় বৃহস্পতিবার সকালেই। বিভিন্ন জেলা থেকে ট্রেনে-বাসে করে আসা চাকরিহারা শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীরা জড়ো হন বিকাশ ভবনের সামনে। সকাল হতেই তাঁরা মূল ফটকের সামনে জমায়েত শুরু করেন। প্রথমে প্ল্যাকার্ড, মাইক, শান্তিপূর্ণ স্লোগান—কিন্তু সময় গড়াতেই উত্তেজনার পারদ চড়তে থাকে। কারণ একটাই—বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও শিক্ষা দপ্তরের পক্ষ থেকে তাঁদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়ার কোনও কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আন্দোলনকারীরা জানান, বহু বছর ধরে তাঁরা প্যানেলে ছিলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অস্বচ্ছতা থাকলেও তাঁদের দোষ ছিল না। তবু উচ্চ আদালতের রায়ে বহুজনের চাকরি বাতিল হয়েছে। “আমরা তো চাকরি পেয়ে পড়াতে শুরু করেছিলাম। এখন তো আবার পরীক্ষা দিতে বলা হচ্ছে, এটা কি আমাদের অপমান নয়?”—প্রশ্ন তুলেছেন হুগলির এক চাকরিহারা শিক্ষিকা সুমনা চট্টোপাধ্যায়।

মার খেয়েও রাতভর আন্দোলনে অনড় চাকরিহারারা

দুপুর গড়াতেই আন্দোলন আরও জোরদার হয়। হঠাৎই একদল চাকরিহারা গেটের লোহার শিক ভেঙে ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। পুলিশ বাধা দিলে শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি। অভিযোগ, তখনই শুরু হয় লাঠিচার্জ। বেশ কয়েকজন শিক্ষক মাথায় চোট পান, রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। আন্দোলনকারী সংগঠনের নেতা অরুণাভ মজুমদার বলেন, “আমরা শিক্ষিত, আমরা শিক্ষকতা করে খাই। আমাদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে কেন এমন বর্বরতা? এটা গণতন্ত্রে চলতে পারে না।” পুলিশ সূত্রে অবশ্য দাবি করা হয়েছে, আন্দোলনকারীরা হঠাৎ আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছিল বলেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে লাঠিচার্জ করতে হয়েছে। ঘটনায় আহত হয়েছেন এক পুলিশকর্মীও।

তবুও রক্ত, আঘাত, অপমান কোনও কিছুতেই দমেননি চাকরিহারারা। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত গড়িয়ে যায়, তবুও তাঁরা বিকাশ ভবনের সামনেই রয়ে যান। হাতে হাত রেখে গঠন করেন মানববন্ধন, গান গেয়ে, স্লোগানে স্লোগানে জানান দেন—এই লড়াই সহজে থামবে না। মধ্যরাতে গিয়ে বৃষ্টি পড়লেও তাঁরা টস থেকে নড়েননি। এক চাকরিহারা শিক্ষক কাঁপতে কাঁপতে বলেন, “শরীর তো কাঁপছেই, কিন্তু আরও কাঁপছে মন। আমরা শিক্ষিত, অথচ ন্যায্য পাওনা চাইতে এসে এমন মার খাচ্ছি, এটা সরকারের লজ্জা হওয়া উচিত।”

এই ঘটনায় বিভিন্ন শিক্ষক সংগঠন ইতিমধ্যেই সরকারের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেছে। ABTA-র এক নেতা বলেন, “চাকরিহারাদের সঙ্গে এমন আচরণ গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোর প্রতি চূড়ান্ত অবমাননা। সরকার যদি আদালতের রায়ের দোহাই দেয়, তাহলে সেই রায়ে দোষীদের শাস্তির পাশাপাশি নির্দোষদের চাকরি ফেরানোর রাস্তাও রয়েছে। সেটা কেন করছে না সরকার?”

শুধু শিক্ষক মহল নয়, সাধারণ নাগরিকের মধ্যেও এই ঘটনার প্রভাব পড়েছে। অনেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় #WeStandWithTeachers হ্যাশট্যাগে পোস্ট করে লিখেছেন, “যাঁরা আমাদের সন্তানদের গড়ে তুলতেন, তাঁদের যদি এমনভাবে রাস্তায় পড়ে থাকতে হয়, তাহলে সমাজ হিসেবে আমাদের ব্যর্থতা কোথায়?” আজ শুক্রবার “ধিক্কার দিবস” পালিত হচ্ছে চাকরিহারা সংগঠনের ডাকে। সকাল থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে পথে নামবেন তাঁরা, সরকারের ভূমিকার বিরোধিতায় সরব হবেন। তাঁদের দাবি, আর কোনও পরীক্ষা নয়, তাঁরা চাইছেন চাকরি ফেরত। সেদিন বিকাশ ভবনের সামনেই ঘোষণা করেন এক শিক্ষক, “সরকারের ভুলের বলি আমরা হব না। মার খেয়েও আমরা লড়ব, যতক্ষণ না চাকরি ফেরত পাই, ততক্ষণ লড়াই চলবেই।”

সরকারের পক্ষ থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি না এলেও শিক্ষা দপ্তরের এক উচ্চপদস্থ কর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। আদালতের নির্দেশ মেনে চলা বাধ্যতামূলক। তবে নির্দোষদের দিকেও আমাদের নজর রয়েছে। কোনও স্থায়ী সমাধানে পৌঁছনোর আগে আলোচনার প্রয়োজন।” রাজনৈতিক মহলেও এই আন্দোলন নিয়ে জলঘোলা শুরু হয়েছে। বিরোধীরা মুখ্যমন্ত্রীর নীরবতা নিয়ে তোপ দেগেছে। বিজেপির মুখপাত্র বলেন, “এই সরকার শিক্ষকদের সম্মান রক্ষা করতে ব্যর্থ। আজকের ধিক্কার দিবস একদিন সরকারের পতনের রাস্তাও খুলে দিতে পারে।”

chakrihara

আন্দোলনকারীদের অনেকেই আশঙ্কা করছেন, যদি এই আন্দোলন অব্যাহত থাকে এবং সরকার নমনীয় না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে আরও বড় গণআন্দোলন শুরু হতে পারে। কেউ কেউ এমনকী অনশনেও বসার ভাবনাচিন্তা করছেন। একজন আন্দোলনকারী শিক্ষিকা বলেন, “আমাদের ঘরে খাবার নেই, সন্তানের স্কুল ফি দিতে পারছি না, অথচ সরকার বলে ফের পরীক্ষা দাও! কতটুকু অসম্মান করলে সরকারের মন গলবে জানি না, তবে আমরা শেষ দেখে ছাড়ব।”

সত্যি বলতে কী, বিকাশ ভবনের সামনে একরাশ কান্না, ক্ষোভ, অপমান আর প্রতিবাদের মধ্যে দিয়ে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে—এই সমাজে কি শিক্ষকদের মর্যাদা সত্যিই আছে? নাকি তাঁদেরও রাস্তায় নামতে হয়, মার খেতে হয়, শুধু প্রাপ্যটুকু ফেরত পাওয়ার জন্য? আজকের এই লড়াই শুধু চাকরির জন্য নয়, এটা আত্মসম্মানের, ন্যায়ের, এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে একটি বার্তা দেওয়ার লড়াই।

RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments