Jaipur blast: রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর, যেখানে ২০০৮ সালের ১৩ মে সন্ধ্যাবেলায় একের পর এক বিস্ফোরণে কেঁপে উঠেছিল গোটা শহর, সেই ভয়াবহ স্মৃতি আজও ভোলেনি কেউ। ওই দিন শহরের ব্যস্ততম আটটি জায়গায়, মাত্র ২০ মিনিটের ব্যবধানে ঘটেছিল ধারাবাহিক বিস্ফোরণ—ত্রিপোলিয়া বাজার, মানস চক, হনুমান মন্দির, চটি চৌপল, জেহেরি বাজার এবং অন্যান্য কয়েকটি জায়গায়। সাধারণত এই জায়গাগুলো সন্ধ্যের সময় মানুষে গিজগিজ করে, কেনাকাটা, ঠাকুর দর্শন, আড্ডা—সব মিলিয়ে এক টুকরো প্রাণবন্ততা। কিন্তু সেদিন সবই নিমেষে থমকে গিয়েছিল। প্রাণ গিয়েছিল অন্তত ৮০ জন নিরীহ মানুষের, আহত হন প্রায় ১৭০ জন। সেদিনের শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল আতঙ্ক, কান্না, রক্ত আর মৃত্যু। ওই দিন চাঁদপোল বাজারের কাছ থেকে আরও একটি বোমা পাওয়া যায়, যেটি সৌভাগ্যবশত বিস্ফোরণ ঘটেনি এবং জয়পুর পুলিশের বম্ব স্কোয়াড সেটিকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়।

এই নৃশংস ঘটনার তদন্ত শুরু হয় সঙ্গে সঙ্গেই। রাজস্থান পুলিশের সঙ্গে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থারাও নেমে পড়ে। বছর পার হতে না হতেই কিছু সন্দেহভাজনের নাম উঠে আসে, যাঁদের মধ্যে ছিলেন সরওয়ার আজ়মি, শাহবাজ হুসেন, সাইফুর রহমান এবং মহম্মদ সইফ। এঁদের বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায়সংহিতা (IPC), নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা (CrPC), বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (UAPA), এবং বিস্ফোরক আইন-সহ একাধিক ধারায় মামলা রুজু করা হয়। বহু বছর ধরে চলতে থাকা বিচারপর্বের মাঝে ২০১৯ সালে শাহবাজ হুসেনকে প্রমাণের অভাবে মুক্তি দেয় এক আদালত, এবং ২০২৩ সালে জয়পুর হাই কোর্ট চার জনকেই মুক্তি দেয়। কিন্তু তদন্তের ভিত্তিতে পুনরায় মামলাটি বিশেষ আদালতে ওঠে এবং অবশেষে গতকাল, ২০২৫ সালের ৮ এপ্রিল, ১৭ বছর পর চার অভিযুক্তকেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দিল জয়পুরের বিশেষ আদালত। পিটিআই সূত্রে জানা গেছে, এই রায়ের সময় আদালত জানায়, “এই অপরাধ শুধু ব্যক্তিগত নয়, এটি সমাজের বিরুদ্ধে, মানবতার বিরুদ্ধে একটি ঘৃণ্য অপরাধ। এই সাজা একপ্রকার ন্যায়বিচার, যদিও প্রিয়জন হারানো মানুষের দুঃখ কমবে না।”

ঘটনার সময় শহরের পুলিশ কমিশনার ছিলেন অশোক রাঠৌর, যিনি এই মামলার তদন্তে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। তিনি আজ বলেন, “যদিও অনেক দেরিতে এই রায় এসেছে, তবে এটি জয়পুরবাসীর জন্য এক স্বস্তির বিষয়। ন্যায় প্রতিষ্ঠা হল, এটিই সবচেয়ে বড় কথা।” বিস্ফোরণে নিজের ছেলে হারানো কান্তি দেবী, যিনি তখন একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করতেন, কাঁদতে কাঁদতে বলেন, “আমার ছেলে তো ফিরবে না, কিন্তু যারা এই কাজ করেছে তারা যেন বাকি জীবন জেলে কাটায়, সেইটুকু শান্তি পেলাম।”
এই বিস্ফোরণের জন্য দায়ী সংগঠনের নাম তদন্তে উঠে এসেছিল ‘ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন’। দাবি করা হয়, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সীমান্ত দিয়ে জঙ্গিরা ভারতে প্রবেশ করে এবং এখানে একাধিক স্লিপার সেল তৈরি করে বিস্ফোরণের ছক কষে। ইন্টারনেটে বিস্ফোরণের আগে একটি ই-মেলও পাওয়া যায়, যাতে স্পষ্টভাবে হামলার হুমকি ছিল, যা পরবর্তী সময়ে ওই সংগঠনেরই বলে প্রমাণিত হয়। এরপর থেকেই ভারতে জঙ্গি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয় সরকার। দিল্লি, মুম্বই, হায়দরাবাদ, আহমেদাবাদ—সব জায়গাতেই সিকিউরিটি বাড়ানো হয় এবং প্রতিটি বড় শহরে অ্যান্টি-টেরর স্কোয়াড গঠিত হয়।
এদিকে এই রায়কে ঘিরে রাজস্থান জুড়ে আবারও পুরনো স্মৃতি ফিরে এসেছে। স্থানীয়দের অনেকেই জানান, “সেই রাতটা এখনও মনে পড়লে শিউরে উঠি। মনে হয়েছিল যুদ্ধ লেগে গেছে। আশপাশে শুধু চিৎকার, অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন, আর আতঙ্ক।” অনেকেই বলেন, “আজকের এই রায় আমাদের মনে করিয়ে দিল যে বিচার হয়তো দেরিতে হলেও হয়।” রাজস্থান পুলিশের মুখ্য মুখপাত্র জানান, “এই মামলাটি একেবারে জিরো থেকে শুরু করে, শতাধিক সাক্ষ্য, ফরেনসিক রিপোর্ট, বম্ব স্কোয়াডের নথি, ফোন কল ট্রেস—সব মিলিয়ে একটি পরিপূর্ণ তদন্ত হয়েছিল। এত বছর পর হলেও চার জন দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় প্রমাণ হয়, বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখা উচিত।”
এই ঘটনার একটি বড় শিক্ষা হল, কেবলমাত্র প্রাথমিক তদন্ত নয়, দীর্ঘমেয়াদি মনিটরিং ও প্রযুক্তিনির্ভর অনুসন্ধান কিভাবে একটি মামলাকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এই মামলার সময়ে দেখা গেছে, আধুনিক প্রযুক্তি যেমন GPS, মোবাইল টাওয়ার ডেটা, ই-মেল ট্র্যাকিং, ফরেনসিক সায়েন্স ব্যবহার করা হয়েছিল, যা বিচারকে মজবুত ভিত্তি দেয়। আদালতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দোষীদের যাবজ্জীবন সাজা মানে তারা শর্তসাপেক্ষ মুক্তিরও যোগ্যতা রাখবেন না।
এই ঘটনাটির প্রেক্ষিতে স্থানীয় রাজনৈতিক দলগুলিও মুখ খুলেছে। কংগ্রেস নেতা সাচিন পাইলট বলেন, “এই রায় ন্যায়বিচারের জয়। একই সঙ্গে আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী হওয়া উচিত, তাও আমাদের মনে করিয়ে দেয়।” বিজেপির পক্ষ থেকে মুখ্যমন্ত্রী ভাসুন্ধরা রাজে বলেন, “আমরা চাই ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর না ঘটে। জয়পুর আজ শান্তিতে থাকুক, সেই কামনা করি।”
এখন প্রশ্ন উঠছে, ১৭ বছর পরে হলেও যদি দোষীদের সাজা হয়, তাহলে কেন এত দেরি হল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছে অনেকেই। আইনজীবীরা বলছেন, দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া, প্রত্যক্ষদর্শীর অভাব, টেকনিক্যাল জটিলতা সব কিছু মিলিয়ে সময় লেগেছে। তবে এতে বিচার হয়নি এমনটা নয়। বরং অনেকেই বলছেন, এই রায় ভবিষ্যতের জন্য এক নজির হয়ে থাকবে।
সেই শহর জয়পুর, যা একসময় ‘গোলাপি নগরী’ হিসেবে পরিচিত ছিল, আজ আবার মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। একসময় ভয় আর আতঙ্কের শহর ছিল যে জায়গা, আজ সেখানে নতুন প্রজন্ম বেড়ে উঠছে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে। কিন্তু স্মৃতি তো সহজে যায় না। তাই এই রায় শুধু চার জনকে সাজা নয়, বরং গোটা শহরের জন্য এক প্রকার মানসিক মুক্তি। এবং ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে একটাই কামনা—আর যেন কোনও শহরে এমন কালরাত্রি নেমে না আসে।